রাত তখন প্রায় দুই টা, লিখতে লিখতে হঠাত চোখ পড়ে ফোনটার দিকে. মেসেঞ্জার টা খুলতে হাই বলে লেখা, প্রোফাইল টা চেক করে নেয় বিমান. নাম অর্পিত রায়, তার নিজস্ব কোনো ছবি নেই প্রোফাইল এ শুধু কুকুরের ছবি আপ ডেট করা. বিমান ও হাই বলে উত্তর দেয়
রিপ্লাই আসে আপনি কোথায় থাকেন
আমি হরি দেব পুর, আপনি?
আমি বারাসাত
ও, বিমান তাকে জিজ্ঞেস করে, প্রোফাইল এ আপনার ছবি নেই দেখলাম, শুধু কুকুরের ছবি দেখলাম, আপনি কুকুর দের খুব ভালোবাসেন বুঝি
হাঁ, শুধু ভালোবাসি নয়, ওরা আমার সন্তান. আমার বাড়িতে তিনটে কুকুর আছে, এরাই আমার এই জীবনের সঙ্গী.
বুঝলাম, কিন্তু সব জিনিসের একটা লিমিট আছে, এটা কি জানেন?
আপনার কথা বুঝতে পারলাম না, একটু খুলে বলবেন বন্ধু.
অবশ্যই, আপনি চানক্যর নাম শুনেছেন?
অর্পিত উত্তর দেয়, হাঁ নিশ্চয়....
ওনার একটা শ্লোক এ আছে সব জিনিসে "অতি" শব্দ টা ভালো নয়.
যেমন, একটা উদাহরণ দেবে বন্ধু আমায়...
হাঁ, নিশ্চয়ই যেমন অতি ভালোবাসা ভালো নয়. কিন্তু আমি এই কথা মানি যে প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব স্বকিয়তা আছে.
একটা ফোন করতে পারি রিপ্লাই আসে.
বিমান উত্তর দেয় করুন
ফোন এর রিংটোন টা বেজে ওঠে, মুছে যাওয়া দিন গুলি, আমার যে পিছু ডাকে,
বিমান ফোন টা রিসিভ করে, হ্যালো, হাঁ বলুন...
আপনার বয়স টা জা নতে পারি কি? ওদিক দিয়ে একটা মহিলার কন্ঠ স্বর জানতে চায়.
বিমান উত্তর দেয় তেত্রিশ.....
তুমি আমার থেকে অনেক ছোটো, তাই তুমি বললাম কিন্তু কিছু মনে করো না কিন্তু,
OK, OK thanks......
না না ধন্যবাদ এর তেমন কিছুই হয় নি, আর বন্ধু দের মধ্যে এমনে ফর মালিটিস, আমি পছন্দ করি না. এবার আসি কাজের কথায়, তুমি কি কারো বন্ধু, যদি বলতে আপত্তি না থাকে তো.
না না আ ত্তি থাকবে কেন? আমি একটা প্রাইভেট কোম্পানি তে চাকরি করি.. বিমান উত্তর দেয় জড়সড় ভাবে.
ও, বিয়ে করেছ?
হাঁ, আমার একটা মেয়ে ও আছে পাঁচ বছরের.
কি নাম মেয়ের?
মেঘলা, মেঘলা হালদার
দারুণ, রোমান্টিক নাম,
আমার সব কিছু তো জেনে নিলে বন্ধু, এবার তোমার কথা একটু বলো pls
আমি, আমার স্বামী নীরব মোদী, আর এক ছেলে, কিন্তু আমার সারা সপ্তাহ কেটে যায় তিনটে কুকুরের সঙ্গে, যারা আমার নিঃসঙ্গ জীবনের একান্ত সঙ্গী.
নীরব মোদী মানে টা বুঝতে পারলাম না.
আমার স্বামী একজন ভবঘুরে লেখক, পঞ্চাশ কথায় একটা উত্তর দেয় না তাই নাম রেখেছি নীরব মোদী, সারা সপ্তাহ কোথায় থাকে জানিনা, মানে আমি ও খোঁজ নেবার চেষ্টা করি না, নিয়ে ও লাভ নেই, রবিবার বাড়িতে আসে, আর ছেলে থাকে দমদম কলেজ এ পড়ায় সে ফেরে শনিবার বিকালে, এই হল আমার জীবন.
ও তাই বলো আর কুকুর গুলো তাই তোমার সঙ্গী তাই তো.
হাঁ, জানো বন্ধু এরা আমার কথা খুব মন দিয়ে শোনে, কিন্তু মানুষ রা শোনেনা, আমি তখন খুব ছোট, আমার যখন আট নয় বছর বয়েস বাবা মারা যায়, মা আবার বিয়ে করে এই বাড়িতে নিয়ে আসেন , মায়ের অত্যাচার সাথে বাড়তে থাকে আমার প্রতি অবহেলা, নতুন বাবা তেমন কিছু না বললে ও আমাকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি সহজেই সেটা বুঝতে আমার বিশেষ অসুবিধে হয় নি , দিদি কে মা খুব ভালোবাসতেl তাই দিদি আমাকে সহ্য করতে পারতো না, আমার জেঠুর কোনো সন্তান ছিল না, জেঠিমা একটা কুকুর পুষেছিল, ছিল বাঘা তার নাম ছিল বাঘা.
বাঘা আমাকে খুব ভালোবাসতেl, সময় পেলে সবার নজর এড়িয়ে আমার কাছে পাগলের মত ছুটে আসতো আদর খেতে. বাঘা আমার কাছে আসুক জেঠিমা পছন্দ করতেন না . আমি তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম. আমার কোলে মাথা দিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়তো.
সেবার ছিল পয়লা বৈশাখ, মা ও বাবা দুই জন সেজে গুজে কোথায় বেরিয়ে গেলো, আর বললো একটু চাল ফুটিয়ে খেয়ে নিবি কিন্তু, এর দিদি তো অনেক আগেই গেছে মামার বাড়ি তে, মা কে জিজ্ঞেস করলাম তোমরা কোথায় যাবে?
উত্তর দেয় জাহান্নামে যাব যাবি তুই, সব কথার উত্তর তোকে দিতে হবে নাকি?
বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে, আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম. বাঘা আসে, আমি তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম.
ধীরে ধীরে আমি উঠে ঘরে চলে গেলাম, বিছানায় শুয়ে শুয়ে বালিশ মুখে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তার খেয়াল নেই.
আচমকা আমার ঘুম ভেঙে যায় চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে. ঘড়ির দিকে তাকালাম, দেখি বেলা এক টা বাজে. খিদেতে পেটে আগুন জ্বলছে, কিন্তু কিছু ছিল না ঘটে. তবু বিস্কুট রাখার প্লাস্টিক এর কৌটা টা হতে নিলাম, ঢাকনা খুলে হতে দিতে প্লাস্টিক কাগজের মধ্যে দুটি ভাঙা টুকরো পেলাম, সেগুলি মুখে দিয়ে জল খেলাম. জেঠুর গলার স্বর শুনতে পেলাম, আমি ভয়ে ভয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম. বারান্দায় একটা বাঁশের খুঁটি তে হেলান দিয়ে বসলাম. জেঠু জেঠিমার হাত ধরে টানতে টানতে ও বাড়ির বারান্দায় নিয়ে এলো. তারপর জেঠু দৌড়ে রান্না ঘরে ঢোকে. জেঠিমা তখনও বাঁশের খুঁটি ধীরে অনর্গল কেঁদে চলেছে, হাতে ভাত লেগে আছে.
জেঠু ভাতের হাঁড়ি টা প্রথমে বাইরে নিয়ে আসে, পরে একটা কড়াই ও নিয়ে আসে, আর চেঁচাতে থাকে,
বলছে, তোর আজ রসের খাওয়া ঘুচিয়ে দেবো, এই
বলে কড়াই এর মধ্যে ভাতের হাঁড়ি টা ঢেলে দেয়, তরকারির সঙ্গে ভাত মাখাতে থাকে,
জেঠিমা বলছে, কি করছেন আপনি, আমার ভুল হয়ে গেছে, আর কোনো দিন হবে না, থামুন, থামুন.
জেঠু জোর করে জেঠিমার হাত ধরে টেনে নিয়ে কড়াইয়ের মধ্যে মুখ টা গুজে দেয়, বলে খা, তুই সব খা..
মুখ তুলে জেঠিমা বলে, এ আপনি কি করলেন, আমি যে মাংস খাই না, ছি ছি.. এ আপনি কি করলেন.
তারপর জেঠু ঊর্ধ্বশ্বাসে বাড়ির বাইরে চলে যায়, গজ গজ করতে করতে.
আমি চুপ করে দেখলাম সবটুকু, আজও বুঝতে পারলাম না তাদের ঝগড়া টা কেনো হয়েছিল সেদিন?
আজও স্পষ্ট মনে আছে সেই দিনের কথা, জেঠিমা পুরো কাড়াই ভর্তি ভাত উঠোনে এক কোণে রেখে, হাঁক দেয়, বাঘা, এ বাঘা......
জেঠিমা ঘরের মধ্যে চলে যায়, মনে হয় স্নান করতে, যাই হোক আমি তখন ভাবছি নিজের কথা.
আমি পেটে হাত দিয়ে বসে ছিলাম, উঠোনে নেমে গেলাম, ইস যদি একটু ভাত পেতাম, দুঃখ লাগলো যে আমাকে একটু ভাত খেতে দিল না.
বাঘা এলো, আমি তাকিয়ে ছিলাম খাবারের দিকে দুর থেকে, বাঘা একটু দূর থেকে খাবার টা দেখলো, এরপর দৌড় এলো আমার কাছে, আমার জামা টা টানতে টানতে নিয়ে গেলো সেই খাবারের কাছে, আমি বলতে লাগলাম,ছাড় বাঘা একটা জামা আমার ছিঁড়ে গেলে, কে কিনে দেবে বল? বাঘা আমাকে খাবারের কাছে নিয়ে গেয়ে, নিজে চলে যায় দরজার সামনে পাহারা দিতে.
আমি আজও ভুলতে পারিনি সেই দৃশ্য. আমি পেট ভরে খেলাম, তারপর চলে এলাম বারান্দায়.
বাঘা আমার কাছে এলো, আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম, কাঁদতে কাঁদতে বললাম যে সমাজের মানুষ এর ভাষা বোঝে না আর তুই, আমার কথা বুঝতে পারলি, আমার খুব খিদে পেয়েছে, আমি হাউ হাউ করে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম.
এরপর বাঘা গিয়ে তার ভাগের খাবার টুকু শেষ করে লেজ নাড়াতে নাড়াতে ঘরে ঢুকে যায়.
জানো বন্ধু NRS হাসপাতালের নার্স যখন কুকুর গুলো কে মেরে ফেলেছে, সেই খবর টা আমি প্রথম ফেসবুক এ পোস্ট করেছি. সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি.
বিমান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বলে বুঝলাম. আচ্ছা শুভ রাত্রি বন্ধু আবার পরে কথা হবে.
OK শুভ রাত্রি.