Monday, April 27, 2020

**২০২০ করোনায় ডরি ***
----হীরামন রায় ----

মারন ব্যাধি মহামারী নবেল করোনা  ভাইরাস, 
 লাদেন থেকেও বহু গুন  বড় এযেন বিশ্বত্রাস।
চোখে দেখা না যায়,      আকাশ পথে বেড়ায়,  
              ঘোরে সে দেশ বিদেশে।
যাকে পায় কাছে,     ধরে গলা টিপে কষে,
              নাস্তানাবুদ নাজেহাল সব শেষে।।
রাইফেল  কমান গোলা বারুদ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম,
থরে থরে সাজানো কোন লাভ নেই নেই তার কোন কাম,
প্রতিকার তবে কি? কি এমন অস্ত্র  আছে,
 ঐ ধুর্তটাকে শাস্তি দিলে এ বিশ্ব যাবে  বেঁচে।
কেউ  বা গোবর কেউ গোমুত্র ঢালিছে গলায় মহাউল্লাসে,
কেউ  মাস্ক কিলিন কিন্তু  তাতে কি হবে?  এই ত্রাসে।
          গোটা বিশ্ব কাঁপিছে  ত্রাসে, 
          ক্ষুদ্র দানব ছড়াচ্ছে যেভাবে। 
চীন, ইটালি, ফ্রন্স,জার্মান মৃত্যু মিছিল যেন,
এতো গবেষণা এর প্রতিকারের অস্ত্র  মিলছে না কেন।
যুগ যুগ  ধরে  ওরা আসে যায়,         মানব সভ্যতা হেলিয়ে দিয়ে যায়, 
                ভিন্ন  রুপটি ধরে।
ধ্বংসের পরে যেটুকু  রবে,          বিজয় উল্লাস তারাই করবে, 
               দানব দলন পরে।।



হীরামন রায় 
রানাঘাট, কেশায়পুর
নদীয়া৷  ৭৪১৫০১

প্রেস বিজ্ঞপ্তিঃ বাডী,ঘর ও হাস মুরগীর খামার জবর দখলের অভিযোগ। 
বরগুনা জেলার বেতাগী থানাধীন পশ্চিম ফুলতলা গ্রামের ১নং বিবি চিনি ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের মুন্সি বাডীর জায়গার মালিক রাবেয়া বেগম, পিতাঃ মোঃ কামাল সিকদার ও তার স্বামী মোঃ জাহাঙ্গীর আলমের নামে খাজা আব্দুল মোতালেবের পুত্র মোঃ /মনির হোসেন ও মোঃ মহিন এর নিকট হইতে গত   ১১/০৭/২০০৫ ইং তারিখে বেতাগি রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রিকৃত সাফ কবলা মুলে ১৪.৫ শতাংশ ভিটে বাড়ি ও নাল জমি ক্রয় করে উক্ত জায়গায় বাড়ি ঘর ও হাঁস মুরগীর খামার নির্মাণ করে ভোগ দখলে স্থিত থাকাবস্থায় গত ২৫/০৫/২০১৯ ইং তারিখে বিকাল ৫ টায় ১ নং বিবিচিনি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ এনায়েত হোসেন ও সাবেক মেম্বার মোঃ শাহজাহান হাওলাদার , রুস্তম চৌকিদার , চুন্নু বিশ্বাস , মজিদ মোল্লা সহ আর অনেকের উপস্থিতিতে রাবেয়া বেগম রানুর খামারটি উদ্ভোধন করেন ।
হাঁস মুরগির খামার ও বাড়ি ঘর দেখা শোনার দ্বায়িত্বে কেয়ার টেকার হিসেবে ছিলেন মোঃ মহারাজ খাজ।
উক্ত জায়গা জমির বিপরীতে মোঃ মোতালেব খাজ গত ২৩/০৮/২০১৯ ইং তারিখে বরগুনার আদালতে একটি ১৪৪/১৪৫ ধারায়  মামলা রুজু করেন। মামলার ভিত্তিতে আদালত হইতে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য উভয় পক্ষকে বেতাগী থানার অফিসার ইনচার্জ এর মাধ্যমে এ এস আই আল আমিন (মুঠোফোনঃ ০১৭১৮-৩৮১৭৬৬ ) এসে নোটিশ প্রদান করে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য উভয়পক্ষকে সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন, এবং সরেজমিনে তদন্ত করে তিনি বরগুনা জেলা আদালতে একটি প্রতিবেদন জমা দেন ।
আইনের প্রতি প্রতি শ্রদ্ধা রেখে রাবেয়া বেগম নির্দেশানুযায়ী যাবতীয় কার্যক্রম স্থগিত করে বাডিঘর ও হাঁস মুরগির খামারের যাবতীয় মালামাল তালাবদ্ধ করে কর্মস্থল চট্টগামে চলে আসেন।
এদিকে ১৪/০৪/২০২০ ইং তারিখে আদালতের নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে  মামলার বাদী মোঃ মোতালেব খাজ ও তাহার পুত্র মোঃ মনির খাজ ও মহিম খাজ সহ ব হিরাগত আরও ১৫/২০ জন সন্ত্রাসী দা-ছুরি ও লাঠিসোটা নিয়ে বাডিঘর ও খামারের তালা ভেঙ্গে ঘর ও খামারের যাবতীয় মালামাল লুটপাট করে বর্তমানেও উক্ত জায়গায় স্বদলবলে দখল করে রেখেছেন। তালা ভেঙ্গে ঘর ও খামারের যাবতীয় মালামাল লুটপাট করার বিষয়টি একই বাডীর বাসিন্ধা মোঃ জলিল ০১৭৯৫৪৪৩৬৮০ নং মুঠোফোনে রাবেয়া বেগম কে  জানালে তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মোঃ রিয়াজকে, ০১৭১১-৪৬৩৪৫৮ ঘটনার বিষয়টি অবহিত করেন এবং পরবর্তীতে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মোঃ রিয়াজ, মন্টু দফাদার এবং শাহীন চৌকিদারকে ঘটনাস্থলে পাঠান। তারা সরেজমিনে গিয়ে হাঁস, মুরগীর খামার ও বাড়ির তালা ভাঙ্গা ও মালামাল লুটপাটের বিষয়টি রিয়াজ মেম্বার  রাবেয়া বেগমকে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন।
উপরোক্ত বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ স্থানীয় প্রশাসনের উর্দ্ধোতন কর্মকর্তার নিকট আকুল আবেদন জানিয়েছেন রাবেয়া বেগম।  
করোনা যুদ্ধে দেশের প্রথম শহীদ চিকিৎসক ডাঃ মঈন উদ্দীন
            মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দীন
ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক গরিবের ডাক্তার খ্যাত সুপরিচিত ডা. মঈন উদ্দীন (রহ)। ব্যক্তিগত ভাবে  তার সাথে আমার কোন পরিচয় নেই, এমনকি কোনদিন দেখাও হয়নি। চলমান মহামারী করোনা ভাইরাসে সিলেটের প্রথম  আক্রান্ত আক্রান্ত হিসেবেই অনেকের মতো আমিও তার সম্পর্কে সোস্যাইল  ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে জানার সুযোগ হয়েছে। ডা. মঈন উদ্দীন (রহ) একদিনে তৈরী হয়নি। তাঁকে এই পর্যন্ত আসতে অবশ্যই অনেক দিন-রাত কষ্ট করতে হয়েছে। গরীবের ডাক্তার খ্যাত এই চিকিৎসক অন্যান্য চিকিৎসকের মতো নয়, সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি তাঁর পুরোটা জীবন মানবসেবায় উৎসর্গ করেন। যেমনি ঢাল কিংবা তলোয়ার বিহীন যুদ্ধে  নামলে যে পরিণতি হবে। তেমনি চলমান এই সংকটে চিকিৎসা সামগ্রী ছাড়া চিকিৎসা দিলে নিশ্চিত করোনা আক্রান্ত আশঙ্কা  হওয়ার সেটা জানার পরও গরীবের ডাক্তার খ্যাত ডা. মঈন উদ্দীন চিকিৎসা সেবা দিয়েছিলেন। চলমান প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসে যখন কিছু স্বার্থপর চিকিৎসক ঘরে থাকার ঘোষণা দেয় তখন গরীবের ডাক্তার খ্যাত এই চিকিৎসক বরাবরের মত মানবসেবায় নিয়োজিত ছিলেন। মানবতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের ক্রান্তিলগ্নে এই চিকিৎসক  নিজেকে গুটিয়ে না রেখে রোগীর সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হন। কিন্তু এই রাষ্ট্র থেকে তিনি আইসিউ অ্যাম্বুলেন্স কিংবা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের সুযোগ সুবিধার আবেদন করার পরও পাননি। এখন প্রশ্ন তুলতেই পারি তিনি কেন সেই সুযোগ সুবিধা পান নি?  তিনি কি কোন রাজনীতির অপহিংসার শিকার? যদি রাজনীতির অপহিংসার শিকার হন! তাহলে তিনি কোন ধারা রাজনীতি করতেন?? তিনি যে ধারা রাজনীতি করুক না কেন জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এমন কি তাঁর বিপক্ষ ধারা রাজনীতি সমর্থক গোষ্ঠী সহ সবাইকে আমরণ চিকিৎসা সেবা দিয়ে গেছেন। গরীবের ডাক্তার খ্যাত এই চিকিৎসক  আজ যদি চেতনার ফেরিওয়ালাদের  কেউ একজন হতেন তাহলে  আইসিউ অ্যাম্বুলেন্স কিংবা এয়ার অ্যাম্বুলেন্স তাঁর কপালে জুটতো। এমন কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও। 
তিনি চলমান মহামারী করোনা যুদ্ধে দেশের প্রথম শহীদ চিকিৎসক। হাদীসের ভাষায়, মহামারিতে মারা যাওয়া ব্যক্তিও শহীদ।  হাদীস শরীফে আছে, আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, পাঁচ প্রকার মৃত শহীদ—মহামারিতে মৃত, পেটের পীড়ায় মৃত, পানিতে ডুবে মৃত, ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে মৃত এবং যে আল্লাহর পথে শহীদ হলো। (সহীহ বুখারি, হাদিস : ২৮২৯) 
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, মহামারিতে মৃত্যু হওয়া প্রতিটি মুসলিমের জন্য শাহাদাত। (সহীহ বুখারি, হাদিস : ২৮৩০)
ডা. মঈন উদ্দীন (রহ)  রাজনীতি  বিভেদ ভুলে তিনি সবাইকে নিয়ে এক কাতারে এসে দাঁড়াতেন। তিনি নিজেকে একজন মানবতাবাদী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। একজন দায়িত্বশীল ও জনদরদী চিকিৎসক হিসেবে তিনি অল্প সময়ে সিলেটবাসীর অত্যন্ত আপনজনে পরিণত হয়েছিলেন। তাই তো এই বীরের মৃত্যুর জন্য আওয়ামীলীগ-বিএনপি, ডান-বাম সকল ধারা রাজনীতি মতাদর্শ সহ সকল শ্রেণীর মানুষ কেঁদে ছিলেন।তিনি দেশের মানুষের হৃদয়ে আজীবন বেঁচে থাকবেন।তিনি চিকিৎসা সেবার জন্য বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম ডাক্তারদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে শাহাদাতের মর্যাদা দিয়ে জান্নাতুল ফেরদাউসের মেহমান হিসেবে কবুল করুক। আমিন।


লেখক: কলামিস্ট। 


লেখা প্রেরক :
মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দীন
C/O,মাওলানা মন্জিল, চন্দনাইশ পৌরসভা, ওয়ার্ড নং ০২, পো: অফিস পূর্ব জোয়ারা (৪৩৮০), চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।
লকডাউনের কাব্য
শুভম রায়

একলাই নয় কেটে যাবে শেষ একুশ!
আজ বড়ই অসহায় সভ্যতার মুখোশ পরে থাকা মানুষ
বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন হয়েছে আজ পর
বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সভ্যতাকে দিতে হচ্ছে উচ্চ কর।
হয়েছে শুরু লকডাউন, বন্ধ হয়েছে যুগের দৌড়।
মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছে যুগের প্রৌঢ়।

ক্ষুধায় কাতর গরীব শিশু, ঘাস পাতা যার সম্বল
বড়লোকদের দুনিয়ায় বিরিয়ানিতে অম্বল।
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে খাবারের নানান ছবি
স্টেশনের ধারে বসে ছেলে বলে মাকে 'একটু ভাত দিবি?'
ক্ষুধার জ্বালায় ভাসায় মা, সন্তানদের জলে
হে বঙ্গমাতা, তোমার বাংলা আজও অনাহারে কাঁদে।

এই করোনার নেই যে কোনো ওষুধ
বিশ্ব জুড়ে তারই খোঁজ, গবেষণাতে বহুদূর
মরুভূমির মরুদ্যান, নাম যার হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন
পারবে কি সে মুক্তি দিতে? আমরা যে বেদুইন।

বৃশ্চিক // বদরুদ্দোজা শেখু
------------------------------------------

ঘুমঘোরে জেগে উঠি , ঝিরিঝিরি ভোরের মলয়
শিরশিরে আমেজ দ্যায়, দেহমন বিরহী হৃদয়
আপ্লুত নন্দিত হয় , পাখিরাও শুনি অনুভব 
করে এই প্রসন্নতা , মৃদু মৃদু সুখী কলরব
ইতস্ততঃ ভেসে আসে, আশপাশে নীরব স্থবির
ঘরবাড়িগুলো ঢুলে দেউড়ির দরমা-টাটির
খিল তুলে, অনাবিল শান্তির প্রহর ঘুরে যায়
জগতের বিপন্ন সত্ত্বার  আতঙ্কিত অসহায়
জনপদ জুড়ে জুড়ে, ফুঁড়ে উঠে প্রাগৈতিহাসিক
মানব-সভ্যতা, প্রত্ন খায় বিশ্বত্রাস করোণা-বৃশ্চিক !!
( ১০ লাইন )
©  বদরুদ্দোজা শেখু
--------------------------------------------------------

কবিতা-২
-------------

ফুলদানিটা / বদরুদ্দোজা শেখু
-------------------------------------

ফুলদানিটা কিনেইছিলাম, ফুল কখনো হয়নি রাখা ,
সৌন্দর্যের কসাই হ'তে চাইলো না তো মনের চাকা 
এবং টাকা--- কেবল টাকার বাণিজ্যটায় রিক্ত আমি
সারা জীবন, থাকার জন্য নিজের কড়ি দেই সেলামী
বই গোলামী বাঁচার জন্য নথিপত্রের অফিসপুরে ,
হৃদয়-বৃত্তি  জীর্ণ হলো বাতিল ইচ্ছার আস্তাকুঁড়ে
অনুভূতির পাপড়িগুলোয় অস্তিত্ত্বের অমোঘ জরা,
ফুলদানিটা ফাঁকাই আছে, ফুল ফোটেনি স্বপ্ন-ঝরা  !!
বর্ষা-খরা অসুখবিসুখ ঘাতপ্রতিঘাত লেগেই থাকে
আমার মনে ফুলদানিটা পুষ্পভোরের স্বপ্ন আঁকে !
থাকে -- থাকে, ইচ্ছেগুলো চারিয়ে থাকে গোপন বুকে
ভরিয়ে তোলে জীবনতরী ভালবাসায় ও ভুলচুকে  ।।

  ( ১২ লাইন )
©  বদরুদ্দোজা শেখু

----------------------------------------

কবিতা-৩
-------------

ইটখোলা বস্তি //বদরুদ্দোজা শেখু
-----------------------------------

শহরের পাশে ওই ইটখোলা বস্তি :
সুখ আর দারিদ্রে অদ্ভুত দোস্তি
হয়েছে ওখানে , দেখি--- সকলেই কর্মী
ইট কাটে ছেলে মেয়ে স্বামী সহধর্মি' ;
বালি দিয়ে পানি সেঁচে মাটি ক'রে চূর্ণ
হলারে ঘুরিয়ে করে ফর্মায় পূর্ণ ।
খসাখস ইট কাটে দেখে লাগে অদ্ভুত ,
রোদে দ্যায় ফালি ফালি মনোরম প্রস্তুত ।
তারপর ব'য়ে ব'য়ে কাঁচা ইট শুকনো
কৌশলে সারি ক'রে ভাটা করে পূর্ণ ,
চিমনিতে ধোঁয়া উঠে , অবশেষে ইট হয় ।
মালিকেরা সেই ইট ছড়ায় শহরময় --
তারা পায় গোছা গোছা অর্থ আময়দা ;
শুধু সামান্য দিন-মজুরির ফয়দা
শ্রমিকের , এও এক শোষণের যন্ত্র
মজুরির মারপ্যাঁচে  বুর্জোয়াতন্ত্র ।
ঘরগুলো বিক্ষিপ্ত ও সংলগ্ন ,
ফুটোফাটা কাণাচটা বিদ্খুটে ভগ্ন 
ইট সাজানো দেয়াল , টাইলের ছাউনি---
জলা আর জংলায় ঝুপড়ির চাউনি ;
যেন ওই ইটখোলা নালন্দা-অস্থি ,
সরীসৃপ আস্তানা তার পাশে বস্তি ।
সারাদিন খাটে ওরা , লাল চা ও খাস্তা
আর পিস্-পাঁউরুটি সকালের নাশতা ,
দুপুর গড়ালে পরে দানাপানি নুনভাত
পেটে পড়ে , পোড়া রুটি আর চায়ে যায় রাত ।
মেয়েগুলো কালো কালো খেটে খেটে হাড়সার---
ইটের ভিটেয় টানে , ঘরে টানে সংসার ;
নামলে মাথার ইট , কাঁখে ভরা ঠিল্লা ।
কালবাউসী রূপের জৌলুস জেল্লা
যুবতীর দেহে ফোটে , তার সে সমস্ত
অল্পদিনেই যায় সহজেই অস্ত ।
বাচ্চাকাচ্চাগুলো পায় না তো শিক্ষা ,
মা'র কোল হ'তে নেয় জীবিকার দীক্ষা ;
ওদের জগতে কম বেকারির কিস্সা---
পেয়েছে ওরা বাঁচার ন্যূনতম হিস্সা :
শুধু ভাত-কাপড়েই চিরকাল তৃপ্ত
জীবন যেন ওদের তলোয়ার দৃপ্ত
দৈন্য করতে জয় , সর্বদা প্রস্তুত ;
সারাদিন শ্রম আর রাতে নিদ্রা নিখুঁত ।
তারি মাঝে বোল তোলে দ্রিমিকি-দ্রাক  মাদল
নাচ গানে জ'মে উঠে হাঁড়িয়ার শোরগোল ,
নিশ্চিত সেই সুখ-সংগ্রামে বন্দী 
আনন্দ-বেদনার বিপরীত সন্ধি ;
ইট না মানুষ--- কা'রা পোড় খেয়ে পোক্ত ?
---প্রতিটি ইটেই লাল শ্রমিকের রক্ত ।।
( ৪৬ লাইন )

©  বদরুদ্দোজা শেখু

-----------------------------------------------------------

কবির নাম-- বদরুদ্দোজা শেখু 
ঠিকানা-- 18 নিরুপমা দেবী রোড ,  বাইলেন 12 ,
        শহর+পোঃ-  বহরমপুর ,   জেলা--মুর্শিদাবাদ, 
        PIN -742101
         পঃ বঙ্গ , ভারত ।  
ফেলে আসা দিন চাঁদ দেখার একাল সেকাল-
           মোহাম্মদ শাহ আমান চৌধুরী
এইতো বছর পাচেক আগে সন্ধ্যার পূর্বে দলবেঁধে ছেলেমেয়েরা একসাথে পূর্ব নির্ধারিত কোন জায়গায় জড়ো হতাম,সবার একটাই উদ্দেশ্য রমজানের চাঁদ দেখা।
মাগরিব আযান পূর্বে কখনো বা উঁকি দিতাম গাছের ফাঁকে কখনো কখনো বাঁশঝাড়র মাথায়।
আস্তেআস্তে বড়জনরাও আসতে শুরু করতো।
কারো কোলে কিম্বা কাঁধে ছোট্ট শিশু, 
সেও আজ চাঁদ দেখার আনন্দ ভাগ করে নিতে আসছে।
মক্তবের সবার থেকে পটু ছেলেটা গুনগুনিয়ে নতুন চাঁদ দেখার দোয়া পড়তো।
লোকসমাগম বাড়তো সবার মনে কৌতূহল চাঁদ কবে দেখবে!
সবার নজর পশ্চিম আকাশে, 
তখন কেউ বলতো চাঁদ দেখছে হুড়মুড়িয়ে একজনের উপর অন্যজন পড়ে যেত চাঁদ দেখার জন্য কিন্তু  একদৃষ্টিতে তাকানোর পর দেখতাম না ওটা চাঁদ নয় ওটা সান্ধ্য তারা।
দূর গা থেকে জয়ধ্বনি শোনা যেত।
কেউ হুট করে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলতো ওইতো কাঁচির মতো ওইতো 
পশ্চিম আকাশে  কাঁচির মত রমজানের চাঁদের হাসির সাথে সকলের মনে খুশির জোয়ার বয়ে যেত।
সবাই সমস্বরে বাধভাঙ্গা উল্লাসে ফেটে পড়তো এপাড়া থেকে ওপাড়া'
গ্রামের অন্ধকারে মেঠোপথ থেকে ইটের পথে মিছিলের এক হইহই রইরই অবস্থা। মিছিলের স্লোগান  "চাঁন উইল্যে চাঁন উইল্যে।
কোলে থাকা অবুঝ শিশু অন্যদের দেখাদেখি সেও আনন্দে মাতোয়ারা।
দূর গা' থেকে শুনা যেত রমজানের মিছিল মনের মধ্যে উত্তাল তরঙ্গ ওঠতো আহা সে কি আবেগ অনুভূতি যেন স্রষ্টা অদৃশ্য থেকে তার রহমতের মাসের রহমত মনের ভেতর ঢেলে দিয়েছে।
আজকের ছেলেমেয়েদের নেই কোন আবেগ অনুভূতি যান্ত্রিক সভ্যতার এসময়ের মানুষের মনও যান্ত্রিক হয়ে গেছে।
বদলে যাবার মিছিলে সব কেমন জানি বদলে গেছে!
হায় আবার যদি ফিরতে পারতাম সেই সোনালী সময় যখন ছিলনা কোন অভিযোগ অনুযোগ ছিল শুধু অবুঝ মনের চাওয়া পাওয়ার দোলাচল।
ভাবতেই কেমন জানি মনের ভেতরটায় মোচড় দিয়ে ওঠে স্মৃতি চৌম্বকীয় ঠান দেয় কিন্তু আমার সেই যাওয়ার মতো চৌম্বকত্বটা যে নেই।

লেখক: সমাজকর্মী ও সংগঠক।
কল্পন
________
নতুন দিনের নতুন আলোকে
রবির কিরণ মাখি, নীলাকাশে
মেঘবালিকারা,উল্লাসী কৌতুকে
মাতি, লুকোচুরি খেলে অবিরাম
দিগন্তরে,বাহি নাও,পাল তুলি।

আমি আছি বসে,বাতায়ন পথে
নিশ্চুপ, একাকী;মন-মুসাফির
ছুটে চলে কল্প-লোকে, দেশান্তরে;
বেদুইন বেশে হাঁ টি মরু-দেশে,
মৃগতৃষ্ঞিকা রাখি অবজ্ঞাভরে।

আবার, কখনও শেরপা সাজে
বরফের দেশে শৃঙ্গ করি জয়;
অসম্ভবকে সম্ভব করি 'হেলে,
আঁকি পদচিহ্ন প্রকৃতির বুকে,
ঘোষিত করি সফলতা হরষে:

চকিতে বিলীন,সব অবসান,
নিঠুর বাস্তব,হয় না এমন।

__________________________






ঠিকানা:-
          উজ্জ্বল কুমার মল্লিক
          জয়পুর, প্রফেসর-পাড়া
           মগরা (৭১২১৪৮)

Sunday, April 12, 2020


জাহেদের পক্ষে চন্দনাইশে আখতারুজ্জামান ফাউন্ডেশনের চিকিৎসা সামগ্রী বিতরণ 



 করোনা ভাইরাসের সংক্রমণরোধে ও সুরক্ষায় গত ১১ এপ্রিল ২০২০ তারিখে সাবেক ছাত্রনেতা জাহেদ হোসেন চৌধুরী বাবুর পক্ষ থেকে চন্দনাইশ উপজেলা প্রশাসন ও চন্দনাইশ থানা পুলিশের কাছে চিকিৎসা সামগ্রী বিতরণ করেছে মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু স্মৃতি ফাউন্ডেশন। স্বাস্থ্য কর্মীদের বিতরণের জন্য শনিবার দুপুরে চন্দনাইশ উপজেলা প্রশাসন ও চন্দনাইশ থানা পুলিশের হাতে পি.পি.ই, মাস্ক, হ্যান্ড  স্যানিটাইজার, হ্যান্ড গ্লাভস হস্তান্তর করা হয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম রহমানি, যুগ্ন সম্পাদক এম শাহনেওয়াজ চৌধুরী,  সম্রাট হোসেন সবুজ, শফিউল আজম রিয়াদ, তারেক হোসেন পিবলু, মোহাম্মদ মাসুদ,জসিম উদ্দীন,আনোয়ার, দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের উপ-সম্পাদক গিয়াস উদ্দীন রায়হান, উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা মাঈনুর রহমান আসিফ, আবদুল্লাহ আল আরমান,তাওহীদ পৌরসভা ছাত্রলীগ নেতা সাজ্জাদ, জাহেদ,ইমন প্রমুখ। (প্রেস বিজ্ঞপ্তি)







বার্তা প্রেরক:
মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল আরমান
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, চন্দনাইশ উপজেলা।

পুনর্জন্ম

সিদ্ধার্থ সিংহ




সিঙ্ঘানিয়া পরিবারে আনন্দের আর সীমা নেই।  তাঁদের একমাত্র মেয়ে আবার তাঁদের কাছে ফিরে এসেছে। কে বলে পুনর্জন্ম বলে কিছু হয় না?
প্রায় আট বছর আগের ঘটনা। প্রিয়াঙ্কার বয়স তখন খুব বেশি হলে সাত কি আট। হঠাৎ বাড়ির মধ্যে থেকে উধাও। চারিদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু হল। থানা পুলিশ করা হল। সিঙ্ঘানিয়া পরিবারের মেয়ে বলে কথা। সমস্ত মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ল। নড়েচড়ে বসল পুলিশ প্রশাসন। সঙ্গে সঙ্গে জরুরি বৈঠক ডেকে উপর মহল থেকে সতর্ক করে দেওয়া হল আকাশ, রেল, জল, এমনকী সড়ক পথের সমস্ত পাহারা-চৌকিকেও।
কিন্তু না। তাকে কোথাও পাওয়া গেল না। প্রতিটি মুহূর্ত তখন সিঙ্ঘানিয়া পরিবারের কাছে যেন এক-একটা যুগ।  বিকেল গড়াতেই অস্থির হয়ে উঠলেন বাড়ির লোকজনেরা। কোনও উপায় না দেখে শেষমেশ বাড়ির কর্তা সংবাদ মাধ্যমের সামনে ঘোষণা করে দিলেন--- যে তাঁর মেয়ের সন্ধান এনে দিতে পারবে, তাকে নগদ দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে
সিঙ্ঘানিয়াদের বিশাল প্রতিপত্তি। চার পুরুষের ব্যবসা। শুধু কলকাতা, চেন্নাই বা বেঙ্গালুরুতেই নয়, তাঁদের ব্যবসা ছড়িয়ে আছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। ফুড প্রসেসিং থেকে নার্সিংহোম, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে চা বাগান, মোটর সাইকেল থেকে সিমেন্ট কারখানা। কী নেই তাঁদের?তেমনই বিশাল বাড়ি। ছবির মতো বিশাল লন। লনের মধ্যে বসার জন্য বড় বড় রঙিন ছাতার নীচে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কারুকাজ করা মেহগিনি কাঠের চোখ ধাঁধানো এক-একটি-টেবিল। সেই টেবিল ঘিরে সে রকমই চারটে, ছ'টা চেয়ার। মর্নিংওয়ার্ক করে এখানেই প্রাতরাশ সারেন বাড়ির কর্তা। কখনও সখনও বিকেলেও বসেন। অফিস বা কারখানার বিশেষ কেউ এলে, এখানে বসেই সেরে নেন ছোটখাটো মিটিং। এমনিও, সময় পেলেই মাঝে মাঝে এসে বসেন। কারণ, এই তল্লাটে এত গাছগাছালিওয়ালা বাড়ি আর দ্বিতীয়টি নেই। থাকবেই বা কী করে!
তিন পুরুষ আগে যখন এই বাড়ি তৈরি হয়, তখন এই জায়গাটা ছিল শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে একটু দূরেই। যাঁরা একটু নিরিবিলিতে থাকতে চাইতেন, তাঁরাই এ সব জায়গায় বাড়ি বানাতেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহর যত বড় হয়েছে, লোপাট হয়ে গেছে নিরিবিলি। উধাও হয়ে গেছে গাছপালা। লোকজনের ভিড় আর গাড়ির ধোঁয়া গ্রাস করেছে আশপাশের অঞ্চল। দেখতে দেখতে জমজমাট থেকে ঘিঞ্জি হয়ে উঠেছে তাঁদের এলাকাটিও।
আগে, বহু আগে যাঁরা বাড়ি করেছিলেন, তাঁদের বংশধরেরা প্রায় সকলেই একে একে প্রোমোটারদের খপ্পরে পড়েছেন। বাংলো টাইপের ছিমছাম বাড়িগুলোর জায়গায় মাথা তুলেছে আকাশ-ছোঁয়া এক-একটা অট্টালিকা। কেউ কেউ নিজে থেকেই বিক্রি করে চলে গেছেন শহরতলিতে। কিছু টাকা দিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই বানিয়ে, বাকি টাকাটা ফিক্সড করে দিয়েছেন ব্যাঙ্কে। তার সুদেই তাঁদের সংসার চলে।
কিন্তু সিঙ্ঘানিয়াদের ব্যাপারটা আলাদা। যত দিন গেছে তাঁদের ব্যবসাপত্র, প্রতিপত্তি এবং ক্ষমতা ততই বেড়েছে। আর তার জেরেই এত কিছুর মধ্যেও তাঁরা ঠিক আগলে রাখতে পেরেছেন তাঁদের পূর্বপুরুষের করে যাওয়া এই বিশাল বাড়ি। আর কেউ যাতে এক বিঘত, দু'বিঘত করে ঠেলেঠুলে তাঁদের সীমানার ভেতরে থাবা বসাতে না পারে, সে জন্য এই কিছু দিন আগেই সারভেন্ট কোয়ার্টার-সহ পুরো বাড়িটাই উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। বাইরে থেকে হুট করে কেউ ঢুকলে মনে হয়, এ কোথায় এলাম রে বাবা! এটা বাড়ি, না বাগানবাড়ি! এই গাছপালার জন্যই বুঝি এত পাখি আনাগোনা করে এখানে। গাছের ডালে বসে কিচিরমিচির করে।
গান নয়, কোনও যন্ত্রসংগীত নয়, এই বাড়ির কর্তার সব চেয়ে প্রিয় হল--- পাখিদের এই কলকাকলিই। আর এটা শোনার জন্যই, যখনই সময় পান, তিনি চলে আসেন এখানে। কান পেতে তন্ময় হয়ে শোনেন সেই মধুর ধ্বনি।
এটা জানতে পেরে কে যেন তাঁকে একদিন বলেছিলেন, এতই যখন পাখির কূজন শুনতে ভালবাসেন, এত জায়গা আপনার, বিশাল বড় বড় খাঁচা বানিয়ে তার মধ্যে ইচ্ছেমতো নানান জাতের পাখি এনে পুষলেই তো পারেন। সেটা শুনে বাড়ির কর্তা তাঁকে বলেছিলেন, খাঁচার মধ্যে বন্দি পাখির ডাক আর প্রকৃতির মধ্যে মনের আনন্দে ডানা মেলে ঘুরে বেড়ানো পাখির ডাক কি এক?
লোকটা অবাক হয়ে বলেছিলেন, কেন? আলাদা নাকি?
উনি বলেছিলেন, অবশ্যই আলাদা। সেটা বোঝার জন্য শুধু কানই নয়, একটা মনও দরকার।
এমনই কূজন-প্রেমিক তিনি। এটা ছাড়াও আর একটা বিষয়ে তার দুর্বলতা রয়েছে, সেটা হল ব্যাডমিন্টন। তাই এই লনেরই এক পাশে বানিয়েছেন ব্যাডমিন্টন কোর্ট। অন্য দিকে সুইমিং পুল। সুইমিং পুলের ও ধার দিয়ে সার সার ঝাউগাছ। সন্ধেবেলায় বাগানের আলোগুলো জ্বললে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কোথা দিয়ে যে সময় গড়িয়ে যায়, বোঝাই যায় না। এ ছাড়াও তাঁর আর একটা হবি হল--- গাড়ি। নতুন কোনও মডেল বেরোলেই হল, তাঁর সেটা চাই-ই চাই। ফলে, বাড়িতে যত না লোক, তার চেয়ে বেশি গাড়ি। এবং কাজের লোক।
সেই সিঙ্ঘানিয়া পরিবারের মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার কথা ছড়িয়ে পড়তেই ছুটে আসতে লাগলেন আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে তাঁদের কোম্পানির তাবড়-তাবড় সব পদাধিকারীরা। আশপাশের রাস্তা ভরে যেতে লাগল নানান রঙের গাড়িতে। তার মধ্যে কত গাড়িতে যে লালবাতি লাগানো কে জানে!
সবার মুখে তখন একটাই কথা, টাকার জন্য কেউ ওকে অপহরণ করেনি তো! ইদানীং খুব শুরু হয়েছে এটা। এখন এ রাজ্যে ব্যবসা করতে হলে শুধু সরকারকে ট্যাক্স দিলেই হবে না, রাজনৈতিক নেতাদের হাত যাদের মাথার ওপরে আছে, তাদের দৌরাত্ম্যও সহ্য করতে হবে। একটু গাঁইগুঁই করলেই শুরু হবে হুমকি, ভয় দেখানো। তাতেও কাজ না হলে বাইকে করে এসে গুলি করে চলে যাবে। এতে ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা পাওয়া যাবে না ঠিকই, কিন্তু না দিলে তাদের সঙ্গেও যে এ রকম ঘটনা ঘটতে পারে, এ রকম একটা আতঙ্ক অনায়াসেই ছড়িয়ে দেওয়া যায় অন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে। ফলে চাওয়ামাত্রই সবাই সুড়সুড় করে টাকা বার করে দেন, সেটা ওরা জানে। আর এটাও জানে, ওরা যাই করুক না কেন, থানা পুলিশ ওদের কিচ্ছু করবে না।
তবু, তার পরেও যদি কেউ বেঁকে বসেন, তখন হুমকি দেওয়া হয় তার ছেলে বা মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়ার। কিংবা খতম করে দেওয়ার।
কিন্তু এ সব তো হয় উঠতি ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে। তাঁদের সঙ্গে এ রকম হবে কেন? আর যদিও বা হয়, কত টাকা চায় ওরা? যাই হোক না কেন, মেয়েকে ফেরত পাওয়ার জন্য তাঁরা সব দিতে রাজি। দরকার হলে অপহরণকারীরা যা চাইবে, পুলিশকে অন্ধকারে রেখেই তাঁরা তা তুলে দিয়ে আসবেন ওদের হাতে।
কিন্তু কত চায় ওরা? সেটা তো আর মোবাইলে ফোন করে জানাবে না। যে বা যারা এটা করেছে, তাদের নম্বর উঠে যাবে। আর যারা করেছে তারা তো খোঁজখবর নিয়েই করেছে। ফলে তারাও জানে, এদের হাত কত দূর... তাই তারা কত টাকা চায়, সেটা জানার জন্য সবাই যখন ল্যান্ডফোনের কাছে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন, এক্ষুনি ফোন এল বলে, প্রতিটা মুহূর্ত উৎকণ্ঠায় কাটাচ্ছেন, ঠিক তখনই কে যেন দৌড়তে দৌড়তে এসে বলল, প্রিয়াঙ্কার নিথর দেহ ভেসে উঠেছে বাড়ির সুইমিং পুলে।
গোটা পরিবার স্তব্ধ হয়ে গেল। রঙিন মাছ রাখার অ্যাকুরিয়ামের মতো প্রায় আস্ত একটা চৌবাচ্চার মাপে বিশাল একটা পাত্র অর্ডার দিয়ে বানিয়ে, দেড়- দু'বছর বয়স থেকেই বাড়িতে দক্ষ প্রশিক্ষক আনিয়ে যে মেয়েকে নিয়মিত সাঁতার শেখানো হয়েছে, যে মাঝে মাঝেই এই  সুইমিং পুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটায়, সে কিনা ডুবে গেল সেই সুইমিং পুলের মাত্র তিন ফুট জলে! এটা হতে পারে! না, কখনও সম্ভব! সন্দেহ হল সবার।
দেহ পাঠিয়ে দেওয়া হল মর্গে। পোস্টমর্টেমে জানা গেল, তাকে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে। কিন্তু তার গলায় আঙুলের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
কে মারল তাকে! পরিবারের সবার চোখে-মুখে তখন একটাই প্রশ্ন। কিন্তু কার দিকে আঙুল তুলবেন তাঁরা! বাড়িতে দশ-বারো জন কাজের লোক। তারাও শোকে বিহ্বল। সব চেয়ে বেশি ভেঙে পড়ল সেই আয়া। জন্মানোর পর থেকেই যে তাকে কোলে-পিঠে করে বড় করে তুলেছে। ও তার সঙ্গে এতটাই জড়িয়ে পড়েছিল যে, প্রিয়াঙ্কা একটু বড় হওয়ার পরে তাকে যখন ছাড়িয়ে দেওয়ার কথা উঠল, সেই আয়া এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে, নিজে থেকেই সে বলেছিল, আমাকে ওর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেবেন না। আমাকে যেটা মাসে মাসে দেন, না হয় সেটা দেবেন না। তবু ওর কাছ থেকে আমাকে চলে যেতে বলবেন না। ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।
সে যেমন প্রিয়াঙ্কাকে ছেড়ে যেতে চায়নি, প্রিয়াঙ্কাও তাকে ছাড়তে চায়নি। তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হবে শুনে রীতিমত কান্না জুড়ে দিয়েছিল। ফলে মেয়ের জন্যই সিঙ্ঘানিয়া পরিবারের কর্তা শেষ পর্যন্ত তাকে আর ছাড়াননি। রেখে দিয়েছিলেন। সেই আয়া দু'দিন নাওয়া-খাওয়া ভুলে তৃতীয় দিন কাঁদতে কাঁদতে জানিয়ে দিল, প্রিয়াঙ্কাই যখন নেই, তখন আমি আর থেকে কী করব?
প্রিয়াঙ্কার একমাত্র দাদা আয়ুষ তখন সবেমাত্র উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে। সিঙ্ঘানিয়া পরিবারের ছেলেরা উচ্চমাধ্যমিকের পর সাধারণত উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি দেয়। কিন্তু হঠাৎ করে অমন একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ায়, বাড়ির লোকেরা তাঁদের সবেধন নীলমণি একমাত্র ছেলেকে আর বাইরে পাঠাতে চাননি। পাঠানওনি।
মাঝখান থেকে পেরিয়ে গেছে আট-আটটা বছর। সিঙ্ঘানিয়া পরিবারও সামলে উঠেছে মেয়ের শোক। আয়ুষও পড়াশোনা শেষ করে শুধু বাবার ব্যবসাতেই যোগ দেয়নি, বলতে গেলে পুরো ব্যবসাটাই রীতিমত দেখভাল করছে। এবং বাবার ব্যবসার পাশাপাশি নিজেও খুলেছে বেশ কয়েকটি অন্য ধারার নতুন ব্যবসা। তার মধ্যে সব চেয়ে বেশি সাড়া জাগিয়েছে যেটা, সেটা হল--- 'সত্যসন্ধানী' নামে তার বড় সাধের প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থা।
না, অন্যান্য ছোটখাটো সংস্থার মতো বিয়ের আগে পাত্রীপক্ষের ফরমাশ মতো তারা পাত্রপক্ষের খোঁজটোজ এনে দেয় না। বিশেষ কারও আবেদনে সাড়া দিয়ে, কারও পিছু পিছু ঘুরে তার গতিবিধির খবরাখবর সরবরাহ করে না। বউ কার সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছে, সে সব নিয়েও ওরা মাথা ঘামায় না।
ওদের সব কিছুই বড় বড়। মারাত্মক কোনও গলদ নজরে আসার পরে, বড় কোনও কোম্পানির কর্ণধার যখন থানা-পুলিশ করার আগে, চুপিচুপি একেবারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর হয়ে নিতে চান, সত্যিই গলদ হয়েছে, না কি তাঁরই ভুল, তখন তিনি ওদের শরণাপন্ন হন। ওরাও ঠিক বার করে দেয় সেই কেলেঙ্কারির নেপথ্যে আসলে কী। প্রথম শ্রেণির খবরের কাগজ বা নিউজ চ্যানেলের হয়ে ঠিক খুঁজে বার করে দেয়, সরকারি বড় কোনও ঘাপলার পিছনে কোন নেতা, মন্ত্রী বা আইএস, আইপিএসরা জড়িত। বিশাল অঙ্কের আর্থিক তছরুপের আড়ালে আসলে কাদের হাত রয়েছে। এই রকম বড় বড় কাজ ছাড়া ওরা হাতই দেয় না।
এই সব নানান কাজে জড়িয়ে পড়ায় আয়ুষ প্রায় ভুলতেই বসেছিল তার বোনের কথা। ঠিক এমন সময় এই খবর। মুখে বুলি ফোটার পর থেকেই নাকি একটি বাচ্চা মেয়ে অদ্ভুত-অদ্ভুত সব কথা বলত। তখন কেউ সে ভাবে গুরুত্ব দেয়নি। এখন তার বছর সাতেক বয়স। আশপাশের লোকেরা বলছে, সে নাকি জাতিস্মর। পূর্বজন্মের কথা সব বলতে পারে। সে বলছে, সে নাকি সিঙ্ঘানিয়া পরিবারের সেই মেয়ে, যাকে তার আয়া গলা টিপে খুন করেছিল।
আয়ুষ পূর্বজন্মে বিশ্বাস করে না। কিন্তু এই খবর শুনে সে আর ঠিক থাকতে পারল না। তার বাবা-মাও সেই মেয়েকে দেখার জন্য এতটাই উতলা হয়ে উঠলেন যে, সব কাজ ফেলে খোঁজ করে করে তাকে যেতে হল ঢাকুরিয়া স্টেশন লাগোয়া, রেল লাইনের ধারে একটি ছোট্ট ঝুপড়িতে। যে-মেয়ে আগের জন্মে অমন একটা পরিবারে জন্মেছিল, সে-মেয়ে এ জন্মে কী করে এ রকম একটা হতদরিদ্র ঘরে জন্মায়! ও কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছিল না। যখন সামনাসামনি দেখল, তার প্রথমেই মনে হল, না, এ মেয়ে কিছুতেই তার বোন হতে পারে না। তার বোনের সঙ্গে এর কোনও মিলই নেই। না-চেহারায়, না-কথাবার্তায়, না-আচরণে। তবু তাকে বাজিয়ে দেখার জন্য সে বলল, তুমি আমাকে চেনো?
মেয়েটি বলল, চিনি মানে? হাড়ে হাড়ে চিনি। তুই আমার হেলিকপ্টারের রিমোর্ট লুকিয়ে রেখেছিলি। কোথায় রেখেছিস রে?
আয়ুষ হতভম্ব হয়ে গেল। ওই মর্মান্তিক ঘটনার ক'দিন আগেই ওর বাবা ওর বোনের জন্য একটা হেলিকপ্টার নিয়ে এসেছিলেন। ওটা রিমোর্টে চলত। বারবার বারণ করা সত্ত্বেও, ওর পড়ার সময় প্রিয়াঙ্কা ওটা ঘরের মধ্যে ওড়াচ্ছিল দেখে, বোনের হাত থেকে রিমোর্টটা নিয়ে ও লুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু সে কথা এ জানল কী করে!
ফের প্রশ্ন করল ও, বলো তো আমি কী জমাতাম?
--- স্ট্যাম্প। এই, তোর কাছে যে মালয়েশিয়ার তিনটে স্ট্যাম্প ছিল, তুই বলেছিলি লায়লার সঙ্গে এক্সচেঞ্জ করে একটা রবীন্দ্রনাথ নিবি, নিয়েছিলি?
আয়ুষ একেবারে থ' হয়ে গেল। হ্যাঁ, তার কাছে একই স্ট্যাম্প দুটো হয়ে গেলে, আর কালবিলম্ব না করে, সে তড়িঘড়ি তার থেকে একটা দিয়ে, তার কাছে যে স্ট্যাম্প নেই, সেটা নিয়ে নিত ওদের স্ট্যাম্প ক্লাবের কারও না-কারও কাছ থেকে। আর মালয়েশিয়ার একই স্ট্যাম্প তিনটি হয়ে যাওয়ায়, সে তার বোনকে বলেছিল--- এই জানিস তো, এই স্ট্যাম্পটা না... লায়লার কাছে নেই। ও একদিন বলছিল এক্সচেঞ্জ করবে। ভাবছি, এর থেকে একটা দিয়ে, ওর কাছে রবীন্দ্রনাথের যে দুটো স্ট্যাম্প আছে, তার থেকে একটা নিয়ে নেব। কিন্তু এ কথা তো সে আর তার বোন ছাড়া অন্য কারও জানার কথা নয়! তবে কি...
আবার কী একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল আয়ুষ, তার আগেই মেয়েটি বলল, সুচিদি কেমন আছে রে?
এ বার আর হতবাক নয়, আয়ুষ একেবারে বোল্ড আউট হয়ে গেল। মিডল উইকেট ছিটকে গেল। কারণ, সূচির  সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা একমাত্র তার বোনই জানত। তার বোনই তার লেখা প্রথম হাতচিঠি পৌঁছে দিয়েছিল সূচির কাছে। তা হলে কি এ-ই তার সে-ই বোন!
আর কোনও সংশয় রইল না। আয়ুষ যখন জানতে পারল, তাদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, জ্ঞাতিগুষ্টি, এমনকী তাদের বাড়ির কাজের কোনও লোকের সঙ্গেও এই মেয়েটির কোনও রকম যোগাযোগ নেই--- যা আছে, তা শুধু পূর্বজন্মের সূত্র ধরেই, তখন সামান্য কুয়াশাটুকুও তার মন থেকে সরে গেল।
আয়ুষের বাবা-মা উঠেপড়ে লাগলেন তাঁদের হারানো মেয়েকে নিজেদের কাছে নিয়ে আসার জন্য। প্রথম প্রথম আপত্তি করলেও সিঙ্ঘানিয়া পরিবারের দেওয়া বিপুল টাকা এবং নানা রকম লোভনীয় প্রতিশ্রুতির কাছে শেষ পর্যন্ত নত হলেন মেয়েটির বাবা-মা। ফলে এ জন্মে অন্য ঘরে জন্মালেও, ও যাঁদের মেয়ে, তাঁদের কাছেই ফিরে এল। গোটা বাড়ি আলো দিয়ে সাজানো হল। অসময়েই মহা ধুমধাম করে করা হল জয় মাতাদির পুজো। সাত দিন ধরে চলল মহোৎসব। দরিদ্রদের মধ্যে বিলি করা হল বস্ত্র। পথবাসীদের হাতে হাতে তুলে দেওয়া হল কম্বল। সব মিলিয়ে আয়ুষদের পরিবার ভেসে যেতে লাগল আনন্দের জোয়ারে।
কোনও মাসে একবার, কোনও মাসে দু'বার, আবার কোনও মাসে তিন বার আয়ুষ ওর বোনকে নিয়ে যেত ঢাকুরিয়া স্টেশন লাগোয়া, রেল লাইনের ধারের ওই ছোট্ট ঝুপড়িতে। ওর মা-বাবার কাছে। না, ওর মা-বাবার এ বাড়িতে ঢোকার কোনও অনুমতি ছিল না। কারণ সিঙ্ঘানিয়া পরিবারের ধারণা ছিল, যে যেখানে যে ভাবে বড় হয়েছে, তাকে সেখান থেকে একদম আলাদা করে তুলে এনে যদি নতুন কোনও জায়গায় রাখা যায়, তা হলে সেখানে থাকতে থাকতে সেও একদিন নতুন জায়গার আদব-কায়দা শিখে পুরোপুরি সেই জায়গার মতো হয়ে ওঠে।
কিন্তু তার শিকড়বাকড় সুদ্ধ তাকে নিয়ে এলে, সেই শিকড়বাকড়ই তাকে এমন ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকে যে, ইচ্ছে থাকলেও তার থেকে সে আর বাইরে বেরোতে পারে না। তাই ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁরা।
কিন্তু মা-বাবা বলে কথা! তাঁরাই বা সন্তানকে না দেখে থাকেন কী করে! তা ছাড়া, মুখে কিছু না বললেও, যাঁদের সঙ্গে ও এত দিন কাটিয়েছে, সেই বাবা-মাকে দেখার জন্য তার মনপ্রাণও তো ছটফট করতে পারে! গুমরে গুমরে কাঁদতে পারে! না, তাকে আমরা আমাদের কাছে রাখতে চাই বলে, তাকে কষ্ট দেওয়ার কোনও অধিকার আমাদের নেই। পরিবারের কর্তা এ কথা বলতেই, সবাই মিলে ঠিক করেছিলেন, তা হলে আয়ুষ তার বোনকে মাঝে মাঝেই তার এ জন্মের বাবা-মায়ের কাছে নিয়ে যাবে। দেখা করিয়ে আনবে।
সেই মতো একদিন প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে যাওয়ার সময় সেই ঝুপড়ি থেকে এক মহিলাকে বেরোতে দেখে আয়ুষ একেবারে চমকে ওঠে। হ্যাঁ, চেহারায় অনেক বদল ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু চিনতে তার কোনও অসুবিধে হয়নি। এই মহিলাটি আর কেউ নন, তার বোনের নৃশংস হত্যাকারী, সেই আয়া।
এ এখানে কী করতে এসেছে! ও-জন্মে মেরে আশ মেটেনি, তাই এ-জন্মেও কি সে তার বোনকে শেষ করতে চায়? কী তার উদ্দেশ্য? খোঁজখবর নেওয়ার জন্য আয়ুষ তার গোয়েন্দা সংস্থা 'সত্যসন্ধানী' থেকে বাছাই করা বেশ কয়েক জন দক্ষ কর্মচারীকে নিয়ে পুরোদস্তুর ঝাঁপিয়ে পড়ল। যদি তেমন কোনও তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করা যায়, তা হলে মাঝখান থেকে আট-আটটা বছর পার হয়ে গেলেও, সেই অপকর্মের জন্য ও এই আয়ার  দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবে। করবেই।
আঁটঘাট বেঁধে, সব খবরাখবর জোগাড় করে, যাদবপুর থানা থেকে তার এক পুলিশ অফিসার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সে একদিন হানা দিল ওই মহিলাটির ডেরায়। পুলিশ আর আয়ুষকে দেখে সে যেন ভূত দেখল। ভয়ে একদম জড়সড় হয়ে গেল। না, একটা চড়চাপড়ও মারতে হল না। দু'-চারটে ধমক দিয়ে জেরা করতেই সে গড়গড় করে বলে গেল---  ওই বাড়িতে কাজ করতে করতেই আমার সঙ্গে রজনীশের আলাপ হয়। ও ছিল ওই বাড়ির গাড়ির চালক। বাড়ির বললে ভুল হবে। ও ছিল প্রিয়াঙ্কার গাড়ির চালক। প্রিয়াঙ্কাকে স্কুলে নিয়ে যেত। নিয়ে আসত। আর আমি যেহেতু প্রিয়াঙ্কার দেখাশোনা করতাম, তাই ওকে ঠিক মতো স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এসেছে কি না, মনে করে ওয়াটার বোতলটা ও নিয়েছে কি না, কিংবা ফিরে এসে কী খাবে, কিছু বলেছে কি না, এ সব ওর কাছেই জিজ্ঞেস করতাম। ফলে সেই সূত্র ধরেই ওই আলাপটা কয়েক দিনের মধ্যেই নিবিড় একটা সম্পর্কে পরিণত হয়। আমরা তখন একে অপরকে না দেখে দু'দণ্ডও থাকতে পারতাম না। দু'জনে একটু একসঙ্গে থাকার জন্য পাগল হয়ে উঠতাম। সুযোগ পেলেই বাড়ির মধ্যেই কোনও ফাঁকা জায়গায় চলে যেতাম। সবার চোখ এড়িয়ে একসঙ্গে নিভৃতে কাটাতাম। আমাদের সব চেয়ে প্রিয় আর নিরাপদ জায়গা ছিল সুইমিং পুলের পিছনে, ঝাউগাছগুলোর ঝোপের আড়াল। সত্যি কথা বলতে কী, আমরা দু'জনে কাছাকাছি হলেই যেন আগুনে ঘি পড়ত। না, আদর তো নয়ই, চুমুটুমুও নয়। এমনকী জড়াজড়ি করেও সময় নষ্ট করার ছেলে ছিল না ও। প্রথমেই আমার শরীর-সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ত। হাবুডুবু খাওয়া শুরু করত। সাঁতার কাটত।
সে দিন দু'জন মালিই ছুটি নিয়েছিল। তাই আমরা সেই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি। সকাল থেকেই তক্কে তক্কে ছিলাম, কখন সুযোগ পাব... বেলা দশটা-এগারোটা নাগাদ সবার নজর এড়িয়ে অবশেষে ওখানে গিয়ে আমরা যখন ভালবাসায় মেতে উঠেছি, এতটাই মেতে উঠেছি যে, কোনও দিকে তাকাবার ফুরসতই নেই। ভুলে গেছি, অন্যান্য দিনের মতো মাঝে মাঝে উঁকি মেরে দেখে নেওয়া, এ দিকে কেউ আসছে কি না। ঠিক তখনই, সুইমিং পুলে নামার জন্য আসতে গিয়ে প্রিয়াঙ্কা বোধহয় কোনও কালো ফড়িং দেখেছিল। আর সেটা ধরার জন্যই পিছু পিছু ধাওয়া করে ও বুঝি ও দিকে চলে এসেছিল। এবং কী করে যেন আমাদের দেখেও ফেলেছিল। বয়সে ছোট হলেও ও বুঝতে পারত সব। আমাদের দেখেই ও বলল, তোমরা এখানে কী করছ? আমি পাপাকে সব বলে দেব।
ওর গলা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা লাফ দিয়ে উঠে পড়েছিলাম। আমি শাড়িটাড়ি পরেই ছিলাম। তাই আমিই প্রথমে ওর কাছে ছুটে গিয়ে এটা-ওটা বলে কথা ঘোরাবার চেষ্টা করলাম। তাতেও কাজ না হওয়ায়, ও যাতে ওর বাবাকে না বলে, সে জন্য অনেক কাকুতি-মিনতি করতে লাগলাম। কিন্তু ও শুনল না। ওর সেই একই কথা, আমি পাপাকে সব বলে দেব।
ও যদি সত্যিই ওর বাবাকে বলে দেয়, তা হলে তো একেবারে সাড়ে সর্বনাশ। চাকরি তো যাবেই, তার ওপরে আরও যে কী কী হবে, তা একমাত্র ভগবানই জানেন। তা হলে এ বার কী হবে! আমরা যখন এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি, রাজনীশ বলল, নাঃ, আর কোনও উপায় নেই। বলেই, আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই, আচমকা ও প্রিয়াঙ্কার গলা টিপে ধরল। ও রকম কোনও ঘটনা যে ঘটতে পারে, আমি তা কল্পনাও করতে পারিনি। আমি একেবারে হকচকিয়ে গেলাম। যখন সংবিৎ ফিরল, আমি ওর হাত ছাড়াবার অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওর গায়ের জোরের সঙ্গে কি আমি পারি!
--- কিন্তু পোস্টমর্টেমে তো আঙুলের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি...
আয়ুষের কথা শেষ হওয়ার আগেই সেই পুলিশ অফিসারটির দিকে তাকিয়ে আয়া বলল, পাবে কী করে? ওই বাড়ির লোকেরা খাবার সার্ভ করার সময় যেমন মাথায় টুপি পরে নেয়, রান্নার সময় রাঁধুনিরা অ্যাপ্রন পরে রান্না করে, ঠিক তেমনই ড্রাইভাররাও সব সময় টিপটপ থাকে। মাথায় হ্যাট, পায়ে শ্যু, হাতে গ্লাভস।
--- আপনি যে বললেন...
--- হ্যাঁ, আমরা ঝাউগাছের আড়ালেই ছিলাম। কিন্তু প্রিয়াঙ্কার গলা শুনেই আমি কেমন যেন ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ও আমাদের ওই অবস্থায় দেখে ফেলেনি তো! কী করব, কী বলব, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। রজনীশের কিন্তু ও সব কিছু হয়নি। ও ধীরেসুস্থে জামা-প্যান্ট, টুপিফুপি পরে নিয়েছিল। ওর হাতে গ্লাভস পরা ছিল বলেই প্রিয়াঙ্কার গলায় আঙুলের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
আয়ুষ বলল, যদি আপনার কথাই বিশ্বাস করতে হয়, তা হলে তো প্রিয়াঙ্কাকে মেরেছে রজনীশ। তা, আপনি সে কথা কাউকে বলেননি কেন?
--- কী করে বলব? আমি যে ওকে ভালবাসতাম।
--- প্রিয়াঙ্কাকেও তো আপনি ভালবাসতেন। কী? বাসতেন না? আপনি তো ছোট থেকে ওকে বড় করেছেন...
--- হ্যাঁ, বাসতাম। ভীষণ ভালবাসতাম। সে জন্যই তো রজনীশকে আমি ক্ষমা করতে পারিনি। ওকে ছেড়ে বিহারে চলে গিয়েছিলাম। ও বলেছিল, তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। তুমি যেও না, প্লিজ। তুমি চলে গেলে আমি আর বাঁচব না। দেখবে, হয় বিষ খাব, নয়তো গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ব। কিন্তু ও যে সত্যি সত্যিই এ রকম একটা কাণ্ড ঘটাবে, আমি তা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।
পুলিশ অফিসারটি জিজ্ঞেস করল, কেন, কী হয়েছিল?
--- ও ট্রেনের তলায় গলা দিয়েছিল। তাই ওর মৃত্যুর খবর পেয়ে, যাদবপুরের দিক থেকে ঢাকুরিয়া স্টেশনে ঢোকার আগেই, বাঁ হাতে, রেল লাইনের যেখানটায় ও আত্মহত্যা করেছিল, তারই সামনের এই ঝুপড়িতে ঘর ভাড়া নিয়ে আমি থাকতে শুরু করি...
--- অদ্ভুত কাকতালীয় তো! আপনি যেখানে থাকতে শুরু করলেন, সেখানেই প্রিয়াঙ্কা জন্মাল!
--- ও প্রিয়াঙ্কা নয়।
চমকে উঠল আয়ুষ, তা হলে?
--- ও আমার মেয়ে।
আয়ুষ অবাক, আপনার মেয়ে!
--- হ্যাঁ, ও আমার আর রজনীশের মেয়ে।
আয়ুষ বলল, সে কী করে হয়! আমি তো ওর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ও আমাকে এমন এমন সব কথা বলেছিল, যা আমি আর আমার বোন ছাড়া অন্য কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
--- এটা আপনার ভুল ধারণা। যেখানে যখন যা হত, প্রিয়াঙ্কা এসে আমাকে সব বলত। আর সেগুলিই খুব ছোটবেলা থেকে আমি আমার মেয়ের মাথায় এমন ভাবে গেঁথে দিয়েছিলাম, ওই বাড়ির ছবি এমন নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছিলাম যে, ও নিজেকে প্রিয়াঙ্কা ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারত না। কিন্তু আমার তো বিয়ে হয়নি, একজন অবিবাহিতা মেয়ের বাচ্চাকে এ সমাজ কিছুতেই ভাল চোখে দেখবে না। আমাকে যেমন নানান লোকে নানান কথা বলত, ওর জন্ম-রহস্য নিয়েও সারা জীবন ওর দিকে আঙুল তুলবে। তাই, কী করব যখন ভাবছি, ঠিক তখনই পাশের ঘরের ওরা আমাকে বলল, বাচ্চাটা আমাদের দিয়ে দাও। আমরা মানুষ করব। ওরা ছিল নিঃসন্তান। ফলে সঙ্গে সঙ্গে আমি রাজি হয়ে গেলাম। আর সেই থেকেই ও ওদের বাবা-মা বলে ডাকতে শুরু করল। ও এখনও জানে না আমি ওর কে...
পুলিশ অফিসারটি জিজ্ঞেস করল, কিন্তু আপনি এটা করলেন কেন? নিজের মেয়েকে ও বাড়িতে ঢুকিয়ে সম্পত্তি হাতানোর জন্য? নাকি হতদরিদ্র ঘরে জন্মালেও আপনার মেয়ে যাতে রাজার হালে থাকতে পারে, সে জন্য?
চোখের জল আর ধরে রাখতে পারল না আয়া। সে বলল, এ সব কী বলছেন আপনারা? আসলে আমাদের জন্যই তো বড়মা'র কোল খালি হয়েছিল, সেই মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন ভেবে তাঁর দুঃখ যদি কিছুটা লাঘব হয়, সে জন্যই এ সব করেছি।
--- সে নয় আপনার কথা বিশ্বাস করলাম। কিন্তু ওর আয়া মানে তো আপনি। আপনি ওকে গলা টিপে খুন করেছেন, এটা ওকে কে বলল?
--- আমি।
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আয়ুষ। ভ্রু কুঁচকে তাকাল পুলিশ অফিসারটি।--- কেন?
--- কারণ, ওর মৃত্যুর পরে যে দু'দিন আমি ও বাড়িতে ছিলাম, তখনই পুলিশের নানান প্রশ্ন এবং ও বাড়ির বিভিন্ন লোকজনের কথাবার্তা, আমার আড়ালে ওদের ফিসফাস, তির্যক চাহনি দেখে বুঝেছিলাম, হাতেনাতে কোনও প্রমাণ না পেলেও, কেন জানি না, ওরা আমাকে সন্দেহ করছে। তাই এত দিন পরে সেই সন্দেহটাকেই ওর মুখ দিয়ে বলিয়ে আমি রাস্তা পরিষ্কার করতে চেয়েছিলাম। কারণ, আমার মনে হয়েছিল, একমাত্র এটা বললেই ও-বাড়ির লোকেরা সহজে বিশ্বাস করবে যে, ও-ই ও বাড়ির মেয়ে।
আয়ুষের দিকে তাকাল পুলিশ অফিসার।--- তা হলে আমরা এ বার থানার দিকে যাই, না কি?
আয়ুষ বলল, থাক। বোনের শোক বাবা-মা একবার সহ্য করেছেন। তাকে ফিরে পেয়েছেন ভেবে এখন তাঁরা খুব আনন্দে আছেন। আজ এটা শুনলে তাঁরা নিশ্চয়ই খুব ভেঙে পড়বেন। আমি চাই না, তাঁরা আর একবার মেয়েকে হারান। তার চেয়ে বরং এই-ই ভাল, যেমন চলছে, চলুক। আর ওই মেয়েটিও যখন মনে করে ও সিঙ্ঘানিয়া পরিবারেরই একজন, তখন অসুবিধা কোথায়? বলতে বলতে আয়ার দিকে ফিরে তাকাল আয়ুষ। বলল, আপনার সব অপরাধ আমি মাপ করে দিতে পারি, শুধু একটা শর্তে। আপনি ওকে কখনও ওর আসল পরিচয়টা জানাবেন না, কেমন?
মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বেরোল না আয়ার। ছলছল চোখে কেবল মাথা কাত করল, আর তাতেই সে বুঝিয়ে দিল, ঠিক আছে।







সিদ্ধার্থ সিংহের পরিচিতি

২০২০ সালে 'সাহিত্য সম্রাট' উপাধিতে সম্মানিত এবং ২০১২ সালে 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। ১৯৬৪ সালে।  ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ই তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় 'দেশ' পত্রিকায়। প্রথম ছড়া 'শুকতারা'য়। প্রথম গদ্য 'আনন্দবাজার'-এ। প্রথম গল্প 'সানন্দা'য়। যা নিয়ে রাজনৈতিক মহল তোলপাড় হয়। মামলা হয় পাঁচ কোটি টাকার। ছোটদের জন্য যেমন মৌচাক, শিশুমেলা, সন্দেশ, শুকতারা, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, চিরসবুজ লেখা, ঝালাপালা, রঙবেরং, শিশুমহল ছাড়াও বর্তমান, গণশক্তি, রবিবাসরীয় আনন্দমেলা-সহ সমস্ত দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতায় লেখেন, তেমনি বড়দের জন্য লেখেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং মুক্তগদ্য। 'রতিছন্দ' নামে এক নতুন ছন্দের প্রবর্তন করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুশো পঁতাল্লিশটি। তার বেশির ভাগই অনুদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। বেস্ট সেলারেও উঠেছে সে সব। এ ছাড়া যৌথ ভাবে সম্পাদনা করেছেন লীলা মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেবসেন, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে। তাঁর লেখা নাটক বেতারে তো হয়ই, মঞ্চস্থও হয় নিয়মিত। তাঁর কাহিনি নিয়ে ছায়াছবিও হয়েছে বেশ কয়েকটি। গান তো লেখেনই। মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতে। তাঁর ইংরেজি এবং বাংলা কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কয়েকটি সিনেমায়। বানিয়েছেন দুটি তথ্যচিত্র। তাঁর লেখা পাঠ্য হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের এক তারিখ থেকে একত্রিশ তারিখের মধ্যে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, মুক্তগদ্য, প্রচ্ছদকাহিনি মিলিয়ে মোট তিনশো এগারোটি লেখা প্রকাশিত হওয়ায় 'এক মাসে সর্বাধিক লেখা প্রকাশের বিশ্বরেকর্ড' তিনি অর্জন করেছেন। ইতিমধ্যে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, স্বর্ণকলম পুরস্কার, সময়ের শব্দ আন্তরিক কলম, শান্তিরত্ন পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, সন্তোষকুমার ঘোষ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, নতুন গতি পুরস্কার, ড্রিম লাইট অ্যাওয়ার্ড, কমলকুমার মজুমদার জন্মশতবর্ষ স্মারক সম্মান, সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা।

SIDDHARTHA SINGHA
27/P, ALIPORE ROAD,
KOLKATA 700027

সেই একাত্তর আজও কাঁদায় !


---রমেন মজুমদার



১২/৪/২০


লাখ লাখ কষ্ট প্রাণ, ত্রাহি ভয়ে যায় মান
কাঁদা জলে ছুটে চলে বাঁচাতে জীবন।
গ্রাম-মাঠ-জঙ্গল পথে, অমঙ্গল রয় গেঁথে
ঘরবাড়ি ছেড়ে ভয়ে পলায় সকল ।

শত প্রাণ অনাহারী--লুট তরাজ কাড়াকাড়ি
কাদা মাখা পথে দৌড় কষ্টের ধক্কল !
দু'ধারে বসত বাড়ি,বাঁশ-মাটির ঘর ছাড়ি
ছুটে যায় মানুষের ঢল ।

জল কাঁদায় মাখামাখি,আটাআটি গাদাগাদি!
ক্ষুধার্থ মানুষ চায় সাহায্যের হাত!
অনাহারে ক্ষুধায় মরে, বৃদ্ধদের যায় ছেড়ে...
কেহ কাঁদে, কেহ পালায় সুদূর তফাৎ ।।

কাদামাখা শরীর খান,ক্ষুধা পেটে কাঁদে প্রাণ
ফ্যাল ফ্যাল মোটা চোখে আকাশটা দেখে,
কোথা হায় ঈশ্বর তুমি,নরকের যেন ভূমি !
নালিশ জানাই আজ কাকে ?

ঘরহীন ঘুমনেই--জলে ভরা রাস্তা ওই !
যুদ্ধে শেষ ঘরবাড়ি আর্মিরা পোড়ায়...
যেন মহামারী রাত, ভাঙে যেন বাঙালি হাত!
আকাশে বোমারু বিমান ওড়ায় ।

ঢাকা হতে কলকাতা,বুকে জমে কত কথা;-
কালোৱাত শেষ হবে কবে কে জানে ?
যশোরের রোড ধরি--শরণার্থী দেশ ছাড়ি
ছুটে আসে ক্যাম্পে ক্যাম্পে তখনে।

স্বাক্ষী থাকে পথ ধুলো,বড় বড় গাছগুলো,
এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাস ,
একমুখো পথ ধরি--ধীর পায়ে মোষ গাড়ি ,
কাঁদা ঠেলে পথ চলে ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস ।!

কত মানুষ ভাত হীনে--মরে ক্ষুধায় দিনে দিনে,
কত লাশ পড়ে থাকে ধান-পাটক্ষেতে,
বৃদ্ধা পিতা-মাতারে--যায় অনেক ত্যাজ্য করে,
বাড়তি বোঝা ফেলে যায় পথে।

ঘর হীন শত শত--কাঁদে মায় পথে কত !
পাগলের মত মাটিতে গড়ায়,
নাই খাবার কাছে তার--শুকনো রুটি করে ধার
রোগা শরীর হাড় গুলো দেখা যায়।

এদিক ওদিক গুলি শব্দ--কানে লাগে জোর স্তব্দ !
কোলের শিশুরা কাঁদে ক্ষুধায়,
রিফিউজির ঘরে নেই--ভালোমন্দ খাবার সেই !
দিশেহারা মানুষের বেঁচে থাকা দায়!

দুঃস্বপ্ন ছেড়ে আসা--ফসলের মাঠ চাষা
সেও ছুটে প্রাননিয়ে ভারত ভিটায়,
ঢাকা কিম্বা কুলিল্লা,সিলেট হতে চাটহিলা
রংপুর-ফরিদপুর,বরিশাল-খুলনায় !

পিঁপড়ার সারি যেমন,কালো মাথা লাইন তেমন
পায়ে হেঁটে শত শত মাইল ছুটে আসে,
আকাশে শকুন উড়ে--কয়খানা চক্কর মারে
দূর হতে দেখে লাশ নদীতে ভাসে ।

মিলিটারি পাক সেনা--বঙ্গের মুক্তি সোনা
দিকে দিকে যুদ্ধ করে মরে ও মারে,
দু'মুঠো ভাত-রুটি--কে দেয় কারে ছুটি
জীবনের হাহাকার চরকি হয়ে ঘুরে।

কার কাছে করি আবদার,বিশ্বেতে চলে দরবার
মৃত্যু যেন মিলিটারির শুকনো মুড়ি !
সারি সারি লাশ ফেলে,মিরপুর-মোহাম্মদ ঝিলে
হাহাকার বীরাঙ্গনা বঙ্গের নারী ।

শামসুন্নাহার-রোকেয়া হলে,ইজ্জতের লুট চলে!
রক্তে ভাসে মেঘনা আর পদ্মার জলে !
পুড়ে দালান বাড়িঘর,পোড়ায় মিলিটারি বর্বর !
কষ্টের করুন কথা কে কাহারে বলে ?


জননীর কোলে শিশু,আধ পেটা ক্ষুধা ইস্যু
বাঁচে কি মরে তার হিসাব নেই ;--
কাঁদে বৃক্ষ গাছপালা--শেয়াল কুকুর করুন গলা
গুলিতে ছিন্ন ভিন্ন দেহ খানা পাই ।

হায় মৃত্যু হায় শরণার্থী -ক্যাম্পে থাকা করুন আর্তি
যুদ্ধে যেমন সংসার স্বজন এলোমেলো,
লক্ষ চোখে আকাশ দেখে--মৃত্যু ভাগ্য কে লিখে?
সবে বলে সব বুঝি-- পুড়ে সব গেলো ।

বর্ষায় ভাসে দেশ,---কত কষ্ট নাই শেষ,
গাদাগাদি যশোর রোড যেন শ্মশান পুরি,
মাথা গোজার ঠাঁই নেই,ক্যাম্পেও দেখি তাই
কালোৱাত ভাগ্যালিপি কপালেতে ধরি।

দিলো ডাক শেখ মুজিব--স্বাধীনতা জ্বালো দীপ!
বিশ্বের মানবতা কেঁদে ওঠে প্রাণ !
আধমরা পূর্ববাংলা, পোড়া গাছ ডালপালা
সৃষ্টির কারুনাতে হবে বুঝি দান ?

বঙ্গদেশ যায় ছাড়ি--শরণার্থীদের ঘর বাড়ি
ভারতের ঘরে চাপে অতিরিক্ত বোঝা !
কলকাতা কৃষ্ণনগড়,--কল্যাণী ধোপাগুর !
সারিবদ্ধ গিজ গিজ মানুষের মৌজা।

ক্ষুধা পেটে দেয় ভাত--ইন্দিরা সেই মহৎ
নিজ পুত্র মনে করে লালন করে,
নয়মাস যায় ধীরে--স্বাধীনতা স্বীকার করে
দেশটারে স্বীকৃতি দেয় বিশ্ব জুড়ে।

হায় প্রাণ হায় শরণার্থী, শেষে ফিরে ইতিউতি
নিজ বঙ্গে খোলা মাঠে করুণা করে।
তারপরেও ভারত পাশে,চাল ডাল দেয় শেষে
আপনার স্বজন ভেবে করুণায় ভরে।।

Wednesday, April 8, 2020

    সোজা হয়ে দাঁড়াবো বলে
   পার্থ সরকার 




সোজা হয়ে দাঁড়াবো বলে
চলমান সিঁড়িতে...
যা বস্তুতঃ রক্তে কাটা
যা বস্তুতঃ সোজা উপরে উঠে কৃষ্ণ গহ্বরের দিকে চলে যায়
এবং সেটা বোমারু বিমানের তুচ্ছতা পাওয়ার পর...

বিদগ্ধ আমি তাতেও  ভ্রূক্ষেপহীন
যদিও রঞ্জন আমার চেয়ে আরো বেশি উচ্চকিত
এই চলমান সিঁড়িতে সোজা হয়ে দাঁড়াবে বলে
আর নীচের দিকে থুতু ফেলেই চলে
আর তখন বিচলিত আমি
স্পষ্ট বুঝতে পারি
আমিই কবিতা লিখি
আমি কবিতাই লিখি
কেননা, আমি থুতু উপর দিকে ছুঁড়ি ।   

পড়ো এই কাব্যলিপি

আব্দুল হান্নান




হে প্রিয়! যদি চিরপ্রেম পেতে চাও তাহলে পড়ো এই কাব্যলিপি; জেনে রেখো! তুমি যে মালঞ্চের মালী, দয়ময় তার কারিগরি। তুমি কি এখনো গাত্রাত্থান করনি হে প্রিয় কবি!তোমার কবিতার আকাশে চাঁদ হেসে উঠেছে।
তোমার ছোট্ট কুটিরে কি এখনো ফুটে উঠেনি, নিশি প্রেমের কুসুম! তোমার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে নক্তচরের দল।
হে কবি! তোমার দুয়ারে একগুচ্ছ কবিতা নিয়ে এসেছে সোনালী জোছনা। এখনো কি তুমি প্রস্বাপনে নিমগ্ন!
হে কবি উঠো! উঠো, মহিয়ানের বিশেষ আয়োজনে শরিক হও; সিক্ত হও স্নেহ শীতল করুনাধারায়। পান করো অমিয় সুধা।
কবির ঘুমের আকাশে কালো বারিনিধি বিদূরিত হলো। কবি কথা বলছে, দুলে উঠছে রহস্যের পর্দা, বাতাসে গভীর মৌনতা। যেন কবির চিত্তালোকে নেমে এসেছে জোস্নাধারা।
কবি আবৃত্তি করছে যেন আকাশ থেকে নেমে আসছে সাড়া। তার চেতনার প্রতিটি তন্ত্রিতে বেজে উঠছে, শব্দহীন সুর। সুরের তরঙ্গে হেসে উঠছে সমুদ্রের হিল্লোল। কবির প্রতিটি শব্দ যেন প্রাতের উচ্ছ্বাস।
কবির প্রেমের প্রস্রবণে যেন সকল আত্মার তৃষ্ণা। সকল আত্মা চর শান্তি ও পরম আবেগ নিয়ে যেন বলছে, হে প্রিয় কবি! বঞ্চিত হৃদয়ে, সঞ্চিত আবেগে তোমার দুয়ারে এসেছি। ধরা দাও, একবার পান করবো তোমার কাব্যলিপি।




®
সিলেট,হবিগঞ্জ

Tuesday, April 7, 2020


গন্তব্য
নাসিমুজ্জামান নীরব 



আজ আবার যাচ্ছি।ঠিক করেছিলাম না,আর কোন মতিভ্রমেই যাওয়া চলবেনা; কিন্তু না  
গেলেও যে নয়।
বেতনটা পেলে পড়ানো বন্ধ;সেটি অবশ্য মুখে বলব না।আল্লাহর কসম বলছি আর কখনও  
ওমুখো হব না,হাতে-পায়ে পড়লেও না।বহুবার কঠিন প্রতিজ্ঞা করেছি যে যাবনা কিন্তু  
যেতে হয়েছে,তবে এই শেষ।প্রত্যেক মাস এরকম।কাল দেব,পরশু দেব, অথচ এক মাস শেষ  
হয়ে আরেক মাস হতে চলল-- দেবার কথাই নেই।গত মাঘে পরীক্ষা চলছিল,পুরো মাসটা টানা  
পড়িয়েছি,অথচ একশ টাকা বেশি দেওয়া দূরে থাক সামান্য কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেনি। 
সালা ছোটলোক!আজ যাচ্ছি,বেতন আজকে চাই ই চাই।আমার হালাল টাকাটা;দেবেনা কেন?একটা  
কুকুর হন্যে হয়ে রাস্তার ধারঘেঁষে কি যেন শুঁকতে শুঁকতে পাশ কাটিয়ে গেল,  
অল্পের জন্য ধাক্কা লাগেনি।চিৎ হয়ে রাস্তার ধূলির মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছিলো যে  
শ্বাস বের হবার জন্য অপেক্ষমান উদ্বাস্তু-উন্মাদ মাতালটা,তার নোংরা গায়ের উপর  
দিয়ে হ্যাংলার মতো চলে গেল,সে টের পায়নি।

সপ্তাহ দুই পূর্বে দূরের এক বন্ধু ফোন দিয়ে বলেছিল --- একটি সার্টিফিকেট  
বানিয়ে দিতে হবে,যে কোন প্রকারে;কত টাকা লাগবে জানাইয়ো।বছর খানেক পূর্বে একটি  
বানিয়ে দিয়েছি,আত্নবিশ্বাস ছিল।নীলক্ষেতের কয়েকটি দোকানে খোঁজ করলাম কিন্তু  
ডিবি পুলিশ মাঝেমধ্যে রেইড দেয়, এই ভয়ে কেউ কাজটা নিতে চাইলো না।পরে নিরাশ হয়ে  
যখন চলে আসছিলাম--- 'কি কাজ বাইজান' বলে ডাক দিল এক অপরিচিতজন,আমি সার্টিফিকেট  
উচ্চারণ করার পূর্বেই থামিয়ে দিল।এক হাজার টাকা লাগবে,করলে জিনিসটা মেইল কইরা  
পাঠাইয়া দেন।আমি বললাম---কাজটা পারবেন তো?সে বললো -- ২ ঘন্টা পরে আইসা নিয়া  
যাইয়েন।আমি দেরি না করে বন্ধুকে বলেছি দুই হাজার টাকা লাগবে, একদম সেম বানিয়ে  
দিবে,এ ও বলতে ভুলিনি যে পূর্বের চেয়ে কাজটা নিখুঁত হবে,কারও বাপের টেংরি নেই  
ধরার,যত তাড়াতাড়ি টাকা পাঠাবা ততই ভাল,কাজটা যে করবে সে চলে গেলে আর হবেনা ১  
মাসের মধ্যে।বন্ধু সঙ্গে সঙ্গে টাকা পাঠালো ঠিকই কিন্তু সে কাজটা আজ দিয়ে  
অর্ধমাস হলো,তাকে পাঠাতে পারিনি।অথচ টাকাটা খরচ হয়ে গেছে।

বন্ধু যাতে ফোন দিয়ে না পায় সে ব্যবস্থা করেছি,মানে ফোন নাম্বারটা বদলেছি।আমার  
তো দোষ নেই,সালার লোকটা যে পারবেনা তা তো জানতাম না।অ্যাডভান্স টাকাটাও আর  
ফেরত নিতে যাইনি।মান-ইজ্জ্বত যা ছিল তা খুঁইয়েছি।ইহজীবনে সেই বন্ধুর সাথে দেখা  
হবার সম্ভাবনাও কম।দৈবভাবে যদি কোনদিন দেখা হয়েই যায় তবে হাত পা ধরে মাফ চেয়ে  
নেব।

যে লোকটা কাজটি নিয়েছিল তাকে মারব বলে শাসিয়েছিলাম একবার।যদিও  সত্যিকার অর্থে  
সে সামর্থ্য আমার ছিলনা,কারণ তার জন্য যথেষ্ট বুদ্ধির প্রয়োজন যা আমার মধ্যে  
অনুপস্থিত;ডাকলে কেউ আসবেনা,উল্টো নিজেই মার খাব।অথচ লোকটা ভয়ে নিজের  
স্যান্ডেল এগিয়ে দিয়ে বলেছিল--- এই স্যান্ডেলডা দিয়া আমারে মারেন ভাই,কাজডা  
আপনার করুম বইলাই নিচিলাম।আপনে কম কইরা ১০০ বার আইচেন,আপনেরে দেইখা আমার মায়া  
লাগচে।আমার প্রিন্টারের সমস্যা না থাকলে নিজেই করতাম।এক শুয়োরের বাচ্চারে দিচি  
করনের লাইগা,সে বান্দা উধাও।ফোন ধরেনা,কেমুন ডা লাগে?পাইলে রক্তগঙ্গা বওয়াইয়া  
দিমু।লোকটার চোখমুখ ক্ষোভে লাল হয়ে ওঠে।নামাজের সময় হইছে বাই,পইড়া আইতাছি,একটু  
খারান বলে লোকটা টুপি হাতে বেরিয়ে পড়ে।

পাশ থেকে আরেক দোকানী কথাগুলো শুনছিল গোপনে,বলল --- হালার পুতেরে পুলিশ ধরছে  
কাইল রাইতে,লোভ!ওহন বুজব ঠ্যালা....তার চোখেমুখে এক চতুর তৃপ্তির হাসি।

প্যাচাল বাড়িয়ে কোন কাজ হবেনা দেখে অপেক্ষা না করে চলে এসেছি। তওবা করেছি, এ  
ধরনের কাজ আর দ্বিতীয়বার নয়।

আজ আর এই মেইন রোড দিয়ে যাব না,আজিজ মার্কেটের পাশের ওই নিরিবিলি রাস্তাটাই এর  
চেয়ে ভাল।প্রচন্ড জ্যাম পড়েছে,ওটা ছাড়লেই ধূলিমেঘে গা গোসল হয়ে যাবে।একটু জোরে  
পা চালিয়ে সামনের ওই নিরিবিলি রাস্তায় দ্রুত পৌঁছাতে হবে।ঠিক স্বাভাবিকভাবে  
হাঁটার অভিনয় করতে হবে যেন লোকে মাতাল না ভাবে ।মাথা ঘোরালেও সমস্যা  
নেই,টিউশনির বাসা পর্যন্ত আমাকে ধৈর্য ধরে যেতেই হবে।নাস্তাটা নিশ্চয় পাব  
ওখানে।গতকাল রাতে আমার রুমমেট খেজুর খাবার সময় সামনে পড়ে যাওয়ায় সম্ভ্রম  
রক্ষার্থে দুটি দিয়েছিল।সকালেই ওটা খেয়েছি,আজকে টিউশনির টাকা পেলে ষ্টার  
কাবাবে যাব।এমন খাব যেন তিনদিন ক্ষুধা না লাগে।

ও....এক্স গার্লফ্রেন্ড  মেসেজ দিয়েছে আজ সকালে।আমি খুব প্রবলেমে আছি,টাকাটা  
ব্যক দিলে খুব হেল্প হতো;যদি পারেন এই নাম্বারে বিকাশ করে দিতে পারেন।নচ্ছাড়  
মেয়েমানুষ;দুদিনেই তুমি থেকে আপনি শুরু করেছে।অন্যের টাকা আমি কখনই মেরে খাই  
না,টাকাটা পেলে আজই তাকে ফেরত দিতে হবে।

  আর একটু;সামনের ওই ঝুলে থাকা ডিস এন্টেনা তারের স্তুপ পার পেরোলেই নিরিবিলি  
রাস্তাটা।সাঁঝ হয়ে অাসছে, নভেম্বর মাস তাই একটু শীত শীত।এইতো,চলে এসেছি।ঝুপড়ির  
ভিতরের মহিলাটা আজও রাস্তার একপাশে আবর্জনায় আগুন লাগিয়ে ধোঁয়া করেছে,কুৎসিত  
ভাষায় মশাকে গালিগালাজ করছে।পাশে এক দামি প্রাইভেট কারের ভেতর এসি চালিয়ে  
আয়েশিভঙ্গিতে আইসক্রিম চাটছে এক ভদ্রলোক।আমি দ্রুত পা চালিয়ে সেই সাইকেল টায়ার  
পোড়ার তীব্র গন্ধযুক্ত ধোঁয়া থেকে মুক্তি পেলাম।
সামনের অফিসার কোয়ার্টারটা পেরোলেই পৌঁছে যাব,আর মাত্র ২ মিনিট।গত পরশু ওখানে  
একটা কুকুরছানা দেখেছিলাম,প্রথমে মৃত মনে হলেও পরে দেখি নিঃশ্বাস নিচ্ছে খুব  
আস্তে আস্তে।বাচ্চাটার পিঠ কোন এক নিকৃষ্ট জানোয়ার খুবলেছে,মাছি পড়ছিল ভঁ  
ভঁ,পোকা কিলবিল করছিল;চামড়ার ধার দিয়ে লাল পিঁপড়ার ঝাঁক কাঁচা মাংশ খাবার  
মহোৎসবে মেতেছিল।অথচ প্রাণীটির মাঝে নিঃশ্বাস ব্যতীত সহজাত প্রাণপ্রাচুর্যের  
চিহ্নটুকু দেখিনি।শুকিয়ে ওঠা মুখ সামনের দিকে প্রসারিত ছিল,মায়াবী কালো  
চোখদুটো শুধু নির্লিপ্তভাবে নড়ছিল বাম থেকে ডানে।নিরুপায় মা কুকুরটি কি ভেবে  
বারবার বাচ্চার পিঠ চাটছিল সেদিন।

দেখি আজ কি অবস্থা।রাস্তার এ অংশটা এখনও ফাঁকা আছে,রাত গভীর হবার সাথেসাথে  
দু'একজন নিশীথিনীর তাঁবু শোভা পায় এখানে,যারা নিশীথে নির্দ্বিধায় আপন করে নেয়  
রিক্সাচালক থেকে স্যুট-ব্যুট পরা ভদ্রলোককে।

চতুর্দিকে দৃষ্টি রেখে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তা অতিক্রম করে চলে আসলাম,বাচ্চা  
কুকুরটি চোখে পড়েনি।শুধু দেখলাম মা কুকুরটি ডাস্টবিনের মধ্যে খাবার খুঁজছে।

ছাত্রীর বাড়িতে যখন পৌঁছালাম,মাগরিবের অাজান দিয়ে দিয়েছে।
ছাত্রীর মা মাঝবয়সী,গোলগাল-ফর্সা চেহারা,স্বাস্থ্য একটু বেজায় বেশি,ডায়াবেটিস  
আছে।নামাজ পড়ছিল যখন,ফ্যান টা অফ করে দিয়েছে ছোট মেয়ে।নামাজ শেষে হাঁসফাঁস করে  
নিঃশ্বাস টেনে চিৎকার জুড়ে দিল,শখের রাজকইন্যা আমার.....মনে হইতাসে নামাজ না,  
আপগানিস্তানে যুদ্ধ করবার গেছি।তার শরীর ঘেমে ভিজে গেছে,শরীরের কাপড় এলিয়ে  
পড়েছে।আমি চুপচাপ ঘরটি পেরিয়ে পড়ানোর টেবিলে গিয়ে বসলাম।ধপ করে একটি কিলের  
শব্দ কানে আসে তখন।দেখি গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে ছোট মেয়েটা।

কিছুক্ষণ পর আন্টি আমাকে নূডুলস খেতে দেয়।লজ্জ্বা মিশ্রিত হাসি দিয়ে বলে--  
বাবা পেঁয়াজ ছাড়াই নূডুলসটা দিলাম,নতুন রেসিপি,ইউটিউব থাইকা শিখছি!গরম গরম  
খাইয়া লও,পেঁয়াজে আগুন ধরছে।

নূডুলস আমার ভেতরে ঢোকে না। টাকাটা খুবই দরকার আন্টি....কিন্তু বলতে পারিনা। 
ভেতরটা শুকিয়ে আসে,পানিতে পিপাসা মেটেনা।

আমি নাস্তা শেষ করে ছাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।হঠাৎ একটি কাগজ হাতে আন্টি  
টেবিলের সামনের বিছানাটায় ধড়মড় করে বসলেন,স্থান-সংকুলান না হওয়ায় এ  ছোট  
জাইগাতে আরও ছোট একটি বিছানা। তোমার ছাত্রীরে তো বাবা খুঁইজা পাইতাছি না।এক  
পোলার লগে নাকি সেন্টমার্টিন গেছে,খোঁজ নাই,এই যে তার চিঠি;আমরা নাকি তার কোন  
শখ-আহ্লাদ মিটাইতে পারি নাই।হুহু করে কেঁদে ওঠে মহিলাটি।আমার ভেতরটা ধক করে  
ওঠে।আমি এতটাই মূর্খ যে ছাত্রী এমন কাজ করতে পারে তা আন্দাজ করতে পারিনি  
একবারও!কেবল নাইনে উঠেছে মেয়েটা।
তার চেয়ে ভেতরে বেশি বাজছে টাকাটা।এই অজুহাতে যদি টাকাটা না দেয় তবে আজ উন্মাদ  
হয়ে যাব।

নাস্তাটা শেষ করার পর কিছু টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে লম্বা গল্প জুড়ে দিলেন  
ছাত্রীর মা,মেয়ে পালানোর গল্প।সে এক দীর্ঘ আখ্যান।যেন কথাগুলো বলার জন্য কতকাল  
কোন শ্রোতাকে পাননি; বলার মধ্যেও কি এক অপূর্ব শান্তি!

কথার এক ফাঁকে শুরু করলেন---বাবা তোমার জন্য পুরা ট্যাকাডাই রাখছিলাম,হঠাৎ  
মাইয়াডা এমুন কাম করলো।বাড়ি ভাড়ার ট্যাকাডাও সাথেই রাখছিলাম,লইয়া গ্যাছে।তুমি  
কিছু মনে কইরো না,বাঁকীডা দুদিন পরেই আইসা নিয়া যায়ো।বিপদে পড়ছি বাবা।

কি আর করা!ভয়ানক রাগ উঠেছিল কিন্তু কিছু টাকা পেয়ে রাগের আগুন নিভেছে, তবে  
বন্যায় ভেসে যায়নি।ভেতরে কি যেন খচখচ করছিল সেটা সাময়িক থেমেছে মাত্র।

বের হবার সময় আঙ্কেল মানে ছাত্রীর বাবার সাথে প্রায় মাথা ঠোকাঠুকি হয়ে গেল। 
ভারী কিসের একটা ব্যাগ হাতে,ক্যাবলা মার্কা হাসি দিয়ে বলল--- লবনের দাম  
বাড়ব,তাই কিইনা আনলাম।আইজ ডাবল হইছে,কাইল থাইকা পাওন ই যাইবনা বুঝি।
আমি ছালামের সাথে কৃত্রিম মৃদু হাসি দিয়ে সড়সড় করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলাম।

বের হয়ে ওই একই পথ ধরে ফেরত যাত্রা।চারিদিক অন্ধকার,মেইন রোডের  
স্ট্রিটলাইটগুলো জ্বলছে।এ রাস্তাটা নিরিবিলি হওয়ায় স্ট্রিলাইটের বালাই নাই।দু  
একটি যা আছে তা সর্বশেষ কবে জ্বলেছিল বলা মুশকিল।আশপাশের বহুতল ভবনের আলোয় যে  
একটু পথ চলা যায়।
এশার আজান হয়ে গেছে।দু'একজন ক্লান্ত শ্রমিক বা রিক্সাচালক নিরিবিলি রাস্তা  
পেয়ে গাঁজায় আগুন ধরিয়েছে।রাস্তাটার শুরু না হতেই সে উৎকট গন্ধ নাকে লাগছে।

সেই অফিসার কোয়ার্টারের পাশে যখন এলাম, ক'জন অপরিচিত লোক আমাকে প্রায়  
চ্যাংদোলা করে দেওয়ালে ঠেসে ধরল।সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়িতে অর্ধগলিত সেই  
কুকুরের বা্চ্চাটা তখন চোখে পড়ে।ময়লার গাড়ির ড্রাইভার আতঙ্কিত ভঙ্গিতে চেয়ে  
আছে।আমার পিঠের ডানদিকে নিচে জ্বলছে।লোকগুলো আমার পকেটগুলো হাতড়িয়ে নিমিষেই  
উধাও।আমি কোন বাধা দেবার বৃথা চেষ্টা করিনি।
সঙ্গে সঙ্গে ময়লার গাড়ির ড্রাইভারটা নিচে নেমে এলো,হালকা রক্ত বের হওয়া দেখে  
তাড়াতাড়ি করে তার গাড়িতে থাকা হেক্সানোল তুলাতে নিয়ে ক্ষতে লাগালো।কপাল ভাল  
প্যাটে ঢুকায় নাই,দুনিয়্যাত বিচার-আচার নাইগো ভাই;লোকটার বলার ভঙ্গিতে কি এক  
অসাধারণ মায়া।তার ভয়ার্ত গলার স্বর সবচেয়ে আপনজনের মতো কানে বাজলো।


কিছু পথ আসার পর দেখি ক্ষতটা যন্ত্রনা করছে,কেমন এক ভয়ানক তীব্র চীন্ চীন্  
ব্যাথা।রাস্তা ঝাপসা হয়ে আসছে।পুরানো মদের ঘোরের মতো চারিদিক নিশ্চুপ হয়ে  
যাচ্ছে।হাজারবার হাঁটা পথ কেমন বদলে গেছে,যেমনটা গিরগিটির গায়ের রং বদলায়।

কোনদিকে যাচ্ছি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।এতো অন্ধকার এ নিঃসঙ্গ রাস্তাটায় জানলে  
তো আসতাম না,পরিচিত পথ ছেড়ে কে কবে অপরিচিত পথে পা বাড়ায়?কোনদিকে যাচ্ছি আমি?এ  
পথ দিয়েই কি এসেছি?
রাস্তার অপরিচিত এক ভদ্রলোক শেষ প্রশ্নটা বুঝি শুনতে পেয়েছে।দেখছি এদিকেই তো  
এগিয়ে আসছে শীর্ণ দেহে;কিন্তু অতটা দূর থেকে শুনতে পাবার তো কথা নয়।নিকটে এসে  
সন্দেহভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-- কই যাবেন?লোকটার দেহ হাড়জিরজিরে  
ধূলিময়,চুলদাড়ি কাটার প্রয়োজন মনে করেনি,জন্মাব্ধি গোসলও করেনি হয়তো,কিন্তু  
তাতে কি!সে বুঝি আমার বহু বছরের পরিচিত কোন লোক;আমি বললাম---জানিনা।ফ্যালফ্যাল  
করে আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে।হাতে থাকা সবকটি পয়সা দিয়ে বললো--- রাইতে  
খায়ো বাইজান,তারপর হো হো করে অট্রহাসি দিয়ে রাস্তার অন্ধকারে মিশে গেল।আমি  
পয়সার মতো জিনিসগুলো ফেলে দিয়ে তার পিছু দৌড় দিলাম,সে ছাড়া আর সবকিছু স্নৃতি  
থেকে মুছে গেছে তখন।তাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন।সে বুঝি সবকিছু জেনে ফেলেছে,আমি  
চিৎকার দিয়ে ডাকলাম অন্ধকারের লোকটাকে,এই শুনে যাও আমি বলছি।

দূর থেকে আবারও প্রশ্ন এলো -সত্যি করে বলো আগন্তুক,কোথায় যাচ্ছো?
অাঁ!আবার শুনতে পেয়েছে?বলছি তবে শোনো---- মনে হয় আমি অন্ধকারেই  
যাচ্ছি,অন্ধকারে.........তোমার কাছে।কিন্তু লোকটাকে কোথাও খুঁজে পেলাম না।



Regards,
নাসিমুজ্জামান নীরব |