Wednesday, April 24, 2019

বড় একা লাগে ( সুন্দর লেখা ) রাজু কর্মকার

বড় একা লাগে

             রাজু কর্মকার





বাইরে তখন সবিরাম জলধারা । তবে বিকালের ব্যালকনিতে উপবিষ্ট অশীতিপর বৃদ্ধার চোখের জলের সাথে তা যেন পেরে ওঠেনা । বিদেশিনী বৌমা আর অচেনা নাতিকে নিয়ে একমাত্র খোকা ততক্ষনে বিমানযোগে ক্যালিফোর্নিয়ার প্রায় কাছাকাছি । ছেলে বিদেশে চাকরি পাবার পর অনেকবারই এমনটি হয়েছে । বিদায় কালে বাঁধা না মানা অশ্রু , ক্ষনিকের ভারাক্রান্ত মন , তারপর অনোন্যপায় বুঝে সামলে নেওয়া __কিন্তু স্বামীর অবর্তমানে আজ যেন তিনি বড় একা । সুসজ্জিত দোতলা বাড়ি , দামী টিভি , রেফ্রিজারেটর , এ সি , দামী ফার্নিচার , পোষ্য টিয়া __ তবু যেন বড় একা তিনি ।
                             সজল ঝাপসা দুটি চোখ স্বামীর ব্যক্তিত্ববান ফটোতে আবদ্ধ হয় । আর তাতে হাত বুলাতে বুলাতে সপরিবারে পুত্র বিদায়ের সে বৃষ্টি ভেজা ক্ষণে স্মৃতি চারণায় ফিরে যান তিনি ..............
                               তার উচ্চাকাঙ্ক্ষী চাকুরিজীবী স্বামী দেবেন্দ্রবাবু চেয়েছিলেন তাদের একমাত্র পুত্র ঋষভকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াবেন , বাংলা মিডিয়ামে পড়াশুনা করে "কিচ্ছুটি" হবেনা গোছের মনোভাব তার । তিনিও স্বামীর সাথে সহমত পোষণ করলেন , কিন্তু "প্রয়োজনে বাইরে সেটেল্ড হয়ে যাবে "কথাটি শুনে কেঁদে ওঠে মাতৃ হৃদয় । স্বামীর প্রতি ব্যর্থ নিবেদন তার , "একমাত্র ছেলেকে ছেড়ে থাকবো কি করে ? " , দেবেন্দ্রবাবুরও চট জলদি জবাব, "ওসব আবেগে ভেসে ছেলেটার কেরিয়ার নিয়ে ছিনিমিনি খেলোনাতো । মোবাইলের যুগে দূরত্ব বলে কিছু নেই । "  পুত্রকে ঘিরে স্বামীর উচ্চাশাকে সেদিন মেরে ফেলতে পারেননি তিনি ।
               পরিকল্পনা অনুযায়ী ভালো ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করানো হলো ছেলেকে । সাথে ক্রিকেট , স্যাক্সোফোন আর ড্রয়িং এর প্রশিক্ষণ । লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে ডিগ্রি লাভ হলো । তারপর সু প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এবং অচিরেই তা পূর্ণতা পেলো । গর্বিত পিতা মাতার মুখে তখন চওড়া হাসি । ক্যালিফোর্নিয়াতে মোটা মাইনের চাকরির হাতছানি ।
                        তবে জয়েন ডেট নির্দিষ্ট হতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন মা । পিতৃ হৃদয়ও কেন জানিনা ডুকরে কেঁদে ওঠে । পূর্ব পরিকল্পনায় কোনো গলদ ছিল কি ? কেননা তিনি তো নিজে বাংলা মিডিয়ামে সফল এবং সুপ্রতিষ্ঠিত । তারা নিজেরাই কি নিজেদের বুক খালি করলেন না !  যাইহোক এসব প্রশ্ন এখন অবান্তর । ছেলের  সু প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে মায়ার বাঁধন থেকে মুক্ত করতেই হবে । কিন্তু মায়ের মন যে বুঝেও বোঝেনা । ছেলেও আসরে নেমে পড়ে মাকে বোঝাতে _" ভালো চাকরি । প্রচুর স্যালারি । হাত ছাড়া করা ঠিক হবেনা মা । প্লিজ বাঁধা দিয়ো না , যেতে দাও । "
                অবশেষে রওনা হবার দিন এসে গেলো । পিতা -মাতা -আত্মীয় পরিজন সকলে মিলে রাজকীয় বিদায় জানালেন আদরের প্রিয়জনকে । রাতের বিমান আকাশে মিলিয়ে যেতেই পিতা মাতা বাকরুদ্ধ । মায়ের কান্না তখন গোঙানিতে পরিনত হয়েছে । কদিন তো একপ্রকার অভুক্ত আর অনিদ্রায় কেটেছে তাদের । তবে কিছুদিন পর  পারস্পরিক বাক্যালাপ আর vdo call এর দৌলতে অনেকটা ধাতস্থ তারা । কিন্তু মনের কোণে হতাশার পাহাড় জমতে শুরু করেছে একটু একটু করে ।
                     তবে দোষ তো আর সন্তানের নয় । কচি মাথায় কেরিয়ারের ভূত তারাই তো চাপিয়েছেন । ইংরেজি মিডিয়াম , খেলাধুলা , গান বাজনা , বিদেশ যাত্রা ..কিছুই নিজের ঠিক করা নয় । তারাই নিজের স্বপ্ন গুলোকে সন্তানের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন । নিজে যা হতে পারেননি , সন্তানকে দিয়ে তা পূরন করার ইঁদুর দৌড়ে নেমে এভাবেই নেমে পড়েন আজকের অভিভাবকরা ।যাইহোক , এখন ছেলের অনুপস্থিতি বড্ড বেশি তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাদের । মন কি অত সব বোঝে !
                            নতুন চাকরিতে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হতে থাকে পুত্র সায়ক । বছরে একবার বাড়িতে আসার সুযোগ হয় । বাকিটা সময় সুযোগ অনুযায়ী ফোনালাপে । অপরদিকে অনোন্যপায় পিতা মাতা ধাতস্থ হতে থাকে একাকীত্বের জীবনে । এভাবেই কাটলো কয়েক বছর ।
                      হঠাৎ একদিন হতাশা আর বেদনার পারদটা চড়ে গেলো, ওপ্রান্তের   "IMO"তে তখন সুন্দরী বিদেশিনী রমণীর সহাস্য মুখখানি । আর ছেলে তখন গর্বিত স্বামী __"দ্যাখো তো মম অ্যান্ড ড্যাডি , কেমন হলো তোমাদের বৌমা ? বিয়েটা সেরেই ফেললাম ।সময় সুযোগের অভাবে তোমাদেরকে জানানো হলোনা । সরি । বাড়ি ফিরে পার্টি দেবো । " ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই অবিরাম বাক্য নিক্ষেপ ।  পিতা মাতার কেবল কম্পিত বুক আর বাঁধ ভাঙা চোখের জল । তার মাঝেও সব যন্ত্রণা ঢেকে "খুব ভালো হয়েছে বৌমা ","খুব খুশি হয়েছি রে ","কবে আসছিস বৌমাকে নিয়ে " ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি । ওপ্রান্ত থেকে এবার নিঃসংকোচ কন্ঠ " হাই মম , হ্যালো ড্যাডি । হাউ আর ইউ ? ইওর সন ইজ সো লভেবল ! ".. জোরপূর্বক হাসির মধ্যেই সমর্থিত হয় সে ইংরেজি বচন ।
                         নিজেদের পছন্দসই পাত্রী দেখে ধুমধাম করে ছেলের বিয়ে দেবার প্রবল ইচ্ছা আর তা অপূরণের ধাক্কা সামলিয়ে বড়সড় পার্টির ব্যবস্থা করলেন তারা , বছর দেড়েকের বিবাহিত জীবনের "নব দম্পতি "র জন্য । মনের আশ মেটাতে কোনো কিছুরই কার্পণ্য করেননি তারা ।দধিমঙ্গল থেকে সিঁদুরদান এবং মনের মতো নানা ভোজন _পদ ..সবেরই ব্যবস্থা ছিল । তবে নব "বাঙালী বধূ"র বর্ধিত অবয়ব কারও নজর এড়াতে পারেনি । আসলে ওদের জীবনে তখন নতুন অতিথি আসন্নপ্রায় ।
                   অবসরের পর সায়কের বাবার ভগ্ন শরীরটা আরও ভাঙতে লাগলো । দুশ্চিন্তা আর রোগে ধরা দেহ ক্রমশঃ পরপারে যেতে প্রস্তুত হয় । চিন্তা ভাবনা গুলো গ্রাস করতে থাকে ঋষভের মাকেও । সুগার , বি পি পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে । খুব অসুস্থতাতেও কাছে থাকার মতো কেউ নেই । আত্মীয় স্বজন খবর পেয়ে আসে , কিছুটা সময় কাটিয়ে চলে যায় । সবাই ব্যস্ত যে যার সংসারে । টাকা আছে , কিন্তু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার লোকের বড়ই অভাব । অপরদিকে নিরুপায় পুত্রও । বৌ _বাচ্চাকে নিয়ে অতিথির মতো ঘুরে যাওয়া ছাড়া তারও কিছু করার নেই । দুজনেরই অফিস আছে ।
                    বিছানায় অবসন্ন দুটি অসুস্থ  শরীর  । দুদিন রান্না হয়নি । পাশের বাড়ির বাপনকে দিয়ে চিড়ে আনিয়ে নিয়েছেন । পরিচিত ডাক্তার এসে দেবেন্দ্র বাবুর কিছু টেস্টের কথা বলে গেছেন _যেগুলি বাড়ি থেকে করানো সম্ভব নয় । বাইরে যেতে হবে , কিন্তু নিয়ে যাবে কে ?  ছেলেও তো প্রায় প্রায় আসতে পারেনা ..উপরন্তু তার "অফিসে খুব চাপ । প্রায় প্রায় যাওয়া সম্ভব নয় । এ তো আর বনগাঁ _শিয়ালদা নয় । কাউকে একটু ডেকে নাও । " বিরক্তির এই পরামর্শে অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন মা । তাই নিজের ভাইপোকে ডেকে পরেরদিনই কোলকাতার একটি বেসরকারি নার্সিং হোমে ভর্তি করান স্বামীকে ।
                      কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি । সেই রাতেই "নিষ্ঠুর " জীবন সাথী তাকে একা করে ওপারে পাড়ি দেন । বর্ণনাতীত কান্নায় ভেঙে পড়েন অশীতিপর বৃদ্ধা । অবশেষে ছেলে বৌ হাজির । কিন্তু অফিসের কাজ আর ভিসাগত সমস্যা মিটিয়ে প্রায় দিন দশেক পর । শ্রাদ্ধানুষ্ঠান মিটিয়ে নিয়ম ভংগের দিনই ফ্লাইট .."অফিসে খুব কাজের চাপ । "
                      তবে ফর্মালিটি মেইনটেন করতে ভোলেনি ঋষভ _"এখানে থেকে কি করবে ? আমাদের সাথে চলো । " যদিও বিদেশিনী বৌমা সে ঝামেলা পোহাতে নারাজ বলে হাত তুলে দিয়েছে । আর তাকে রাজি করানো গেলেও তিনি তার স্বামীর ঘর ছেড়ে কেনই বা যাবেন  ?
                          ...... ধীরে ধীরে বাস্তব জগতে ফিরে আসেন তিনি । কেন মানুষ সন্তান ধারন করে ! কাড়িকাড়ি টাকা খরচ করে লেখাপড়া শিখিয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত করে , কেনই বা পরিকল্পনা করে বিদেশে পাঠায় .. তা কি শুধু গর্ব ভরে পাঁচটা মানুষকে শোনাবার জন্য ? .."আমার ছেলে অ্যাবরড থাকে । মোটা মাইনের চাকরি করে । "..বড় একা লাগে তার । কিন্তু এই একাকিত্বের জন্য তিনি বা তারাই দায়ী । তাই কারও বিরুদ্ধেই কোনো অভিযোগ নেই তার । আর এভাবেই ফলের আশা না করে অভিভাবকরা তাদের সন্তানের প্রতি কর্তব্য সম্পাদন করে যাবেন । তখনও সজল চোখে স্বামীর ফটোতে হাত বুলাতে বুলাতে সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করেন তিনি ।
                 শেষ হলো ।
রাজু কর্মকার
বেড়গুম , হাবড়া , উ 24প , প :ব :
9775513785

No comments: