Friday, March 15, 2019

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানভাসে নষ্টনীড়

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানভাসে


এখানে আমি খুব একটা অসহায় প্রাণী ।জগতে সবাই থাকতেও আমি বড় একা। দিন গুলো যেন ফুরাইতে চাহে না । এভাবে কি আর চলিতে পারে ? প্রায় ছয় মাস পার করিলাম, কত দল আসিল, কত দল চলিয়া গেল, কত মানুষের দেখা মিলিলো ।কেবল আপন কেহউ আসিল না।
 আঘাতের পর আঘাত লাগিলে প্রথম প্রথম অসহ্য যন্ত্রণা হয় কিন্তু কোন এক সময় হৃদয় তাহা মানিয়ে লয়। তবুও বড় ভাইদের মন ভরে না , দিনের শেষ হয় কিন্তু র্যাগিং শেষ হয় না।
হঠাৎ কেমন করিয়া যেন সময়ের কাটা টি উল্টো দিকে ঘুরিয়া গেলো, ডলি নামটা আপন আপন লাগিতে লাগিলো । অবশেষে ভাল একটা বন্ধু হল , যদিও নাম ছিল ডলি তবুও ঐ নামে আমি তাহার ডাকিতাম না।
কে জানিত,এমন এক দিন আমার জীবনে আসিবে । কাদামাটির মানুষ, তাই হয় তো এতটুকু কখনওই ভাবিতে পারি নাই । গ্রামটা সরু পথের ধারে,দুপাশে মাঠ, মাঠে হাজারো মানুষ, কৃষক যাদের নাম, মুখে যাই বলুক,অন্তত্ব অন্তর এত কালো না । সেখানেই আমার জন্ম । যাহা বুঝি তাহা খুব সহজেই বুঝি, সর্পের মত আঁকাবাঁকা পথে চলতে আমরা অভ্যাস্ত নয় । তাই বুঝি এত বিপদ আসিয়া গনিয়া ধরে মোদের দুয়ারে ।

জীবনটা শুরু হয়েছিল, অ আ,  ক খ  ( স্বরর্বণ ব্যঞ্জনবর্ণের) দু'চারটি লাইন দিয়ে ।এমন কেহ্ ছিল না যে, ABCD ইত্যাদি হাতে ধরিয়া শিক্ষাইবে। সারাদিন এদার ওদার  কিংবা মাঠে থাকিতে হইত বাপজানের সাথে । রাতে ফিরিয়া মনের মধ্যে নাঙ্গল ফেলিয়া চাষ করিতে হইত বইয়ের পাতা , তাহাতে যা সাধনা হইতো , তাহার ফসল সরুপ  কিছু একটা পেয়ে থাকিব ভবিষ্যতে । সাধনা করিলে ,ঈশ্বর না দিয়ে পারে না । তিনি তো আর হারামজাদা নয়, ঈশ্বর সে তো দয়ার সাগর। সাগর বলিয়া তাঁহার বুকে পুঁটি মাছ থেকে শুরু করে তিমি মাছ সহ হাজারও প্রাণীর ঠাঁই । সে যদি একটু নিষ্টুর হত । কত না ভাল হত। রাক্ষসীরূপী মাছ গুলো আর হয় এত অন্যায় করিতে পারিত না ।

যাহা বলিতে ছিলাম,  ঐ দু'চার লাইনের সাধনা চলিতে লাগিল দির্ঘসময়।
সাধনা নামক নদী থেকে বেড়িয়ে আসিতে লাগিল অমৃত রস । সেই রসের ভরে আমিও ফুলিয়া ফাপিয়া উঠিতে লাগিলাম ।প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণী করিয়া আমার বিদ্যার শ্রেণী কক্ষ বেড়ুতে থাকিল। কখন যে উঠিয়া গিয়েছিলাম দ্বাদশ শ্রেণীতে, তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারছিলাম না । H S C  নামক পরীক্ষায় কলম ভাঙ্গিয়া উত্তীর্ণ হইতে পেরে আনন্দের মহাসমুদ্রে ভাসিতে লাগিলাম । সকল বন্ধু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হইবে বলিয়া,  ঘরের কপাট আর খুলিলো না । অন্ধকার মহলে লুকিয়ে গেল সবাই, প্রায় তিন মাস আমিও তাহাই করিলাম,  পড়া শেষ । সবাই উইপোকা মত বেড়িয়ে এল গর্ত থেকে ।
জীবনের প্রথম নিজ গ্রাম,  নিজ জেলা শহর ছাড়িয়া বাইরে আইলাম, এর আগে শুধু এক বার জেলা শহরে আসিয়া ছিলাম । কিন্তু আজ প্রয়োজনের তাগিদে বাংলাদেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তরে ছুটে চলিতেছি ।
অবশেষে পাইলাম ভর্তি হইতে নিজের ইচ্ছে বাইরে, বাড়ি থেকে চার শত কিলোমিটার দূরে একটা ইউনিভার্সিটিতে। নিজের বলতে তেমন কেহউ রহিল না, যাহাই আছে দু'একজন জেলা শহরের খুব ব্যস্ত প্রাণী, দেখা মেলে সুন্দরবনের বাঘের মত।

যদিও আমার ঠিকানা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন হলেও হইয়া উঠিল না ,কিন্তু ডলির ঠিকই হইয়াছিল, বাবুই পাখির বাসার মত।
ডলির সাথে বন্ধুত্ব হই বার পরে অনেক কাহিনী ঘটিয়া যায় । ম্যাচে থাকিতে আমি আর পারছিলাম না । ডলি তাহার এক বড় আপাকে (মুলিকা) বলিয়া আমার জন্য হলে সিটের ব্যবস্থা করিয়া দিল। হলে আসিতে আমার মনে হইল ,কুয়ার ব্যাঙ সাগরে আসিয়া পড়িয়াছে।
এমন এক অবস্থা হইয়া উঠিল আমার যেন, আমি আমার জন্য রাজ-মুকুট হাতে পাইয়া বসিলাম । কত বড় ভাই বড় আপু , কি আনন্দ!
ডলিই আনিয়া দিল এই জীবনে নতুন সূর্যের প্রতাপ । সে শুধু আমার বন্ধু না, সে আমার কাছে হিরার চেয়ে দামি হইয়া উঠল। বন্ধু কি বস্তু তাহা হইত আমার জানা বাকি থাকিয়া যাইতো ,যদি ডলি এই ভুবনে না আসিত।
যদিও দুই জনই ছিলাম দূরপ্রাচ্যের বাসিন্দা,  তবুও একে অন্যকে খুব বুঝিতাম ।
আর্থিক নামক বস্তু যে কি তাহা আমাদের পোশাক দেখিলেই বুঝা যাই তো, একই পোশাকে প্রতিদিন ক্লাস করিতাম যাহা বিশ্ববিদ্যালয় বলিয়া কাহারও চোখে পরে নাই । আমি ভাবিতাম লাল পোশাক টা ওর হইতো খুব প্রিয়, তাই প্রতিদিন পড়ে আসে। কিন্তু বস্তুত আর্থিক সমস্যা ।

হঠাৎ একদিন ডলি আর আমার সাথে কথা বলে না, এমন কি চেয়েও দেখে না। তৃষ্ণার্ত কাকের মতো চেয়ে থাকি তার প্রাণে , সে ফিরেও দেখে না ।আমি যেন অসহায় এক কুত্তা।

ছেড়ে দিলাম সব । মনে সুখ নেই , কোথাও জায়গা নাই, দিশেহারা হইয়া উঠলাম । অবশেষে ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দিলাম । ক্ষমতাসীন দল । অরাজকতা চলাফেরা । এখানে আর যাই হক , পেটে ভাত থাক বা না থাক, বুক ভরে গরমের সাথে চলা যায় । আর কিছু পাই বা না পাই ,দুবেলা ঠিক মতই গাঁজা পাইতাম, যা সেবনে ডলির প্রতি ঘৃণা করিতে মন এক ফোঁটাও ক্লান্ত হইত না।
যত দিন যায় তত স্বার্থপরের মত শুধু সুবিধা নিতে থাকিলাম। রাজনীতি যে কি বস্তু তাহা দূরে থাকিলে বুঝা যায় না ,শুধু গন্ধ পাওয়া যায় । প্রথমে মিটিং তারপর ফিটিং , চিটিং এবং সর্বশেষে ছাটিং  । রাজনীতি মানে হল দুনিয়ার যত নোংরা কাজ আছে তাহা করা ,প্রয়োজনে নিজের পিতাকে হত্যা করা।
আমাকেও ঠিক এমনই রুল মেনেই চলিতে হইত। প্রথম প্রথম নেতার চারিদিকে দাঁড়িয়া থাকিয়া নেতার সিগারেটের টান গুলো ভাল ভাবে আয়েত্ব আনিতে হইত । তারপর নেতার বিশ্বস্ত হলে, নেতার সাথে নেঙা কুত্তার মতো পিছু পিছু এদিক সেদিন  ঘুরিয়া বেড়ান । নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের ধুমকান । মারপিট । দলের জনগণ বৃদ্ধি করা । মিথ্যা বলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মনে আশা জাগিয়ে দলে ভীর করা। হল দখল ইত্যাদি ।
যত দিন যায়  তত হৃদয়ে কালি পরিতে থাকে ।ঠিক লোহার মরিচা পড়ার মত।
আমার আকাশের নিচ আজ আর কেউ নেই। তাই নিদ্বির্ধায় যে কোন অন্যায় করিতে পারি । বাঁধা দেওয়া আর কেউ নেই । আজ আর কোন ডলি নেই যে বাঁধা দিবে । পাপের বুঝা এত পরিমাণ বেড়ে গেল যে মাপার কোন যন্ত্রেই পরিমাণ করা সম্ভব না ।সাধারণ সম্পাদক শান্তাহার ভাইয়ের আদেশে শিক্ষক থেকে শুরু করিয়া অসংখ্য ছাত্রকে পিঠাইছি। সাধারণ সম্পাদকে আদেশ বলে কথা , জীবন দিয়া হইলেও পালন করিতে হইবে।
এইতো কিছু দিন আগে সেক্রেটারি গ্রুপ এবং সাধারণ সম্পাদকে গ্রুপের গুলাগুলিতে হলের সভাপতি মামুন ভাই মারা গেলে ।
তার কিছু দিন পরে দপ্তর সম্পাদক কামিল ভাই ইয়াবা নিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পরলো । শান্তাহার ভাইয়ের প্যানেলেই কাজ করিতো । অবস্থা বেগতির দেখিয়া , শান্তাহার ভাই এখন কামিল ভাইকে আর চেনে না।
কামিল ভাইয়ের কাজ এখন আমাকে করিতে হয়। বিনিময়ে এমন কোন সুবিধা নাই যা আমি পাই না । মেয়ে থেকে শুরু করে  নেশা পর্যন্ত , সব সুবিধাই আমার হাতের নাগালে । এ যেন আলাদিনের প্রদীপ আমার হাতে।
আমি যত পরিবর্তন হই , ততই পরিবর্তন দেখি ডলির মাঝে । ডলি আজ কাল কি ভাবে এত আর্থিক স্বচ্ছতা আসিল। আমি যেন রাজনীতি করি ,দুহাতে টাকা কামায়, দুহাতে টাকা উড়াই । কিন্তু ডলি কি ভাবে এত অর্থ পায়। যার একদিন বাদাম খাওয়ানর মত পয়সা ছিল না , সে যেন আজ রানী ভিক্টোরিয়া ।

আজ বৃহস্পতিবার । খবর এলো বিকাল পাঁচ টায় আহমেদপুর ঘাটে মাল আসিবে , প্রায় লক্ষ খানিক পিচ বড়ি। পৌঁছায়ে দিতে হবে মাজাহারপুর থানার সাধারণ সম্পাদকে কাছে। তারপরে এসে জেলা শহরে থাকতে হবে একটি হোটেলে।

যাই হক ঘাটে থেকে মাল নিয়ে রওনা দিলাম , পথে দেখি পুলিশ নামক ভিক্ষুক দাঁড়িয়ে গাড়ি তল্লাশি করছে । এস আই সাজিদ কে কাছে ডেকে বললাম "শান্তাহার ভাই"।এক হাজার টাকা দু খানা নোট দিতেই গালাগালি পেরে ছেড়ে দিল । মাজাহারপুর পৌঁছাইতে রাত নয় টা বেজে গেল । মাল দিয়া সোজা হোটেলে চলিয়া আসিলাম ।
হাত মুখ ধুয়ে, খাবার-দাবার সেরে কেবলি বিছানায় শরীর রাখিতে না রাখিতেই । দরজায় করা নড়ে উঠল। আল্লাহ্ জানে, আবার কে ।  দরজার ছিদ্র দিয়ে দেখলাম , একটা মেয়ে মানুষের পা । মনটা বিরক্তে ভরে উঠিল। কেন যে ভাই, এসকল ব্যবস্থা করে । হোটেলের ম্যানেজারকে একশত বার বলিয়াছি, আর না, আমার আর মেয়ে মানুষ ভাল লাগে না । শালা বদজাত ম্যানেজার বলে কি, মেয়েরা নাকি হরিণের মত, হরিণ যেমন বাঘের স্বাস্থ্য জন্য উপকারী, মেয়েরা তেমন পুরুষের স্বাস্থ্য জন্য দরকারি ।
যায় হক, দরজা খুলে মুখ খানা ঘুরাতেই, পিছু থেকে ভেসে আসিল একটা কথা।
"সরি  ভাই, একটা Client ছিল , তাই একটু দেরি হয়ে গেল"।
কথা গুলো যেন , আমার হৃদয়ে মৃত আগ্নেয়গিরি থেকে জ্বলন্ত লাভা টেনে বের করিতে লাগিল  । মরুভূমির বুকে ধাধা করে আগুন জ্বলে উঠিল।
এ আমি কি শুনিলাম,  কার কথা আমার কানে ভেসে আসিল । যাকে ভালবেসে পেলাম না, সে আজ মনের অজান্তে এখানে এসে তার সব সম্পদ বিলিয়ে দিতে চায় ।
সাহস হচ্ছিল না ডলির মুখ পানে চাইতে , তবুও তাকাইলাম; সাদা-লাল মুখ গানা , দু চোখ যেন আজ তার খর স্রোতা পদ্মা নদী । নুনা জলে ভাসিয়া যাইতে লাগিল তাহার বুক । দেখিয়া সইতে পারছিলাম না । বুকে টানিয়া লইলাম।
কান্না আহাজারিতে রুম ভরিয়া উঠিল । কোন কথা নাই কারও মুখে । কান্না আর কান্না । বার টা বার  মিনিটে প্রথম মুখ খোলিলাম আমি:-
----- এখানে কেন ?
---- যানি না ।
---- তার মানে?
---- আমি কিছু জানি না, শফিউল ।
----- ডলি..........
---- হুম বলো।
----- তুমি এ পথে কেমনে আসলা?
----বলতে পারব না ।
---- কেন বলতে পারবা না?  তোমাকে বলতেই হবে ডলি।
---- না, শফিউল আমি পারব না । please, শুনতে চেয়েও না । সইতে পারবা না ।
---- তুমি যদি না বল তাহলে আমার মরা মুখ দেখবে।
---- শফিউল এ কি বলছো?
---- হুম । তোমাকে বলতেই হবে।
----- শুনতে চাও
---- হুম বল ।
----- তোমাকে বাঁচাতে,  শফিউল ।
--- মানে?
---- শান্তাহার ভাই বলে ছিল যে, তার সাথে চাঁদপুর যেতে হবে এবং এক রুমে থাকতে হবে । আমি যদি রাজি না হয় তাহলে , তোমাকে ওরা মেরে ফেলবে। তাই আর নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় পেলাম না । তার কথায় রাজি হয়ে গেলাম। তারপরে মুলিকা আপু এই পথে নিয়ে আসে। হোটেলেই আমার আয়ের উৎস শফিউল ..............।

----- আমাকে বেড়ুতে হবে ডলি, সময় আর বেশি নাই। তুমি ঘরে ফিরে যাও। আজ আমার কিংবা শান্তাহারের জীবনের শেষ দিন।
এই বলে বিছানার নিচ থেকে শান্তাহারের দেওয়া চকচকে টিপ চাকু আর কিছু সিগারেট নিয়ে বেড়িয়ে গেলো শফিউল ।

ডলি বাঁধা দিতে চেষ্টা করলো । কিন্তু সমুদ্রে বুকে ভেসে আসা সাইক্লোনের মুখে এই ছোট মেয়ে মানুষ ডলি কোথায় যে ছিটকে পড়িল তাহা ডলি বুঝেও উঠতে পাড়িল না ।

ডলি কানে শুধু ভেসে আসলো দরজা লাগার মৃদু শব্দ টা। ডলির রক্ত বর্ণ মুখ খানা থেকে শুধু উচ্চারিত হতে লাগল, " ভেঙে ফেল শফিউল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানভাসের ঐ কাল বাগান গুলো ভেঙে ফেল,  ছিরে ফেল কাল ফুল গুলো ছিরে ফেল, মুক্ত হক বিশ্ববিদ্যালয়, ফুটুক স্বপ্নের ফল। রাজনীতির কাল জালে না পড়ুক বাঁধা এই অবলা নারীর দল। ভেঙে ফেল শফিউল ভেঙে ফেল" ।



শাবলু শাহাবউদ্দিন
পাবিপ্রবি

No comments: