লিখে রাখা কথাগুচ্ছ
রুদ্র সুশান্ত
আগেরকার দিনে গ্রামগুলো ছিলো ছবির মতোন, আর আজকাল গ্রামগুলোতে হিংসার প্রতিচ্ছবি, মুহূর্তে মুহূর্তে হিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে। নেভানোর চেষ্টা কেউ করেনা বরং বর্ণচোরার মতোন মুখ লুকায়ে সবাই সেই জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢালতে চায়, আবার কেউ কেউ পর্দার অন্তরালে থেকে উস্কানি দেয়। মানুষের চরিত্র বুঝার উপায় নেই। মানুষ ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র সময় সময় উন্মোচিত করে, পৃথিবী মানুষকে প্রাপ্য দিলেও মানুষ পৃথিবীকে প্রাপ্যটা দিতে বড্ডোই কৃপণতা করে। গ্রামগুলোতে বর্তমানে এমোন লোকের ভিড়ই বেশি, ভালো লোক নগণ্য আর এই নগণ্য সংখ্যারা-ই নির্যাতিত।
এখানে সমাজপতি থেকে রাজনীতিবিদ, ধর্মগুরু থেকে শিক্ষাগুরু সকলেই কেবল সু্যোগের অপেক্ষা করে। সুযোগ পেলেই ছোঁ মেরে সে সুযোগ নেয়, সুযোগ না পেলে চিপাচাপায় থেকে সুযোগ নিতে চায়। বড্ডো অসহায়ের থাকে গ্রামের সাধারণ জনগণ। আর আজকাল ধর্মতন্ত্রীরা ধর্মের চে' পরনিন্দার চর্চা অধিক করে, এই নিয়ে কেউ দ্বিমত করলে তাঁকে দ্বিমত করার স্বাধীনতা আমি দিলাম তবে আমার তথ্য অসত্য নয়। সাম্প্রতিককালের বহু উদাহরণ আমি দিতে পারবো, লেখাটা অনর্থক দীর্ঘায়িত করার অভিপ্রায় কম বলে আজ লিস্ট দিলাম না।
আমাদের সোনার গ্রাম গুলোতে খুঁজলে এখন আর সোনা পাওয়া যাবে না। কারণ ধর্ম আমাদের কাছ থেকে মিলনাত্মক সোনা কেড়ে নিয়েছে, কারো ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলার অধিকার আমি সংরক্ষণ করিনা, তবে আমার কথা আমি বলতে পারি সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই বলা।
আগে বেশ মেলা হতো গাঁ'য়ে, লোকসমাগম হতো, কিন্তু এখন তেমনটা আর নেই, পাছে ধর্ম যাবার ভয় আছে। বাউলে মেলাকে বিতর্কিত করা হচ্ছে যদিও বাউলরা বাঙলির অস্তিত্ব বহন করে। আরো বহু মেলা অশ্লীলতার তকমা লাগিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। একটি মেলা সব ধর্মের লোকদের একত্রিত হবার সু্যোগ করে দেয়। কিন্তু এখন মেলাগুলো তেমন আর দেখা যায় না। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পয়েলা বৈশাখের মঙ্গল শোভা যাত্রাকে শিরক ঘোষণা করতে একদল মুখোশধারী ধর্মতান্ত্রিক সদা উদ্যত।
এখন গ্রামে যা চলে তা হলো সোজা বাঙলায় কামড়াকামড়ি। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে হিংসার বহুমাত্রিক বিকাশ ঘটেছে। আগেরকার সেদিনের মতোন "মানুষ ছিলো সরল" স্লোগান এখন মিথ্যা। বাপ-চাচারা এখন আর একসাথে বসে খাওয়া দাওয়া করেনা, বাপ-চাচাদের ভিতর কোন্দল লাগিয়ে সুবিধা নিচ্ছে তৃতীয় কোন পক্ষ। আর গ্রামে রাজনীতি আজকাল পঁচে গেছে। যারা রাজনীতি বানানটাও ঠিকমতো জানেনা, যাদের কোন আদর্শ নেই, যাদেরকে রাজনীতি কেন করেন জিজ্ঞেস করলে কোন উত্তর প্রদান করতে পারবেনা কিংসা যে দলের সমর্থক বা নেতা সে দলপতির আদর্শ এবং আদর্শিক দিক আদর্শগত দু'টো বাক্যও বলতে পারবে না তারা সবাই এখন গাঁ'য়ের নেতা (অবশ্য নেতা হতে এসবের অত্যবশকীয় কোন ধরা বাঁধা নিয়ন নেই, তবুও তো কোন না কোন কারণ থাকা চাই)।
আর এসব নেতাদের দ্বারা নিয়মিতভাবে দলিত হচ্ছে গ্রামের দুর্বল সম্প্রদায়, তিনবেলা খেয়ে শান্তিতে ঘুমাবো সেসব দিন এখন আর গ্রামে নেই, আপনি শান্তিতে থাকতে চায়লেও কেউ না কেউ আপনার উপর অশান্তিরজল ছিটাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে আছে, তাদের নাকের ডগায় মাছি উড়লেও আপনি দোষী। এমনি তাদের বাড়ীর বউ পুকুরপাড়ে পা মছকালেও নিরীহ সম্প্রদায় দোষী।
আর মাস্তানদের উপদ্রব তো বর্ণনাতীত।
আমাদের গ্রাম আমি জন্ম থেকে যা দেখেছি এখন আর তা নেই, হয়তো আপনাদের গ্রামেও। নেই কোন খেলার মাঠ, ছেলেরা বিকেলবেলা দল বেঁধে খেলতে যায়না, মেয়েরা দলে দলে কানামাছি খেলে না,একদল অবাধ্য বালক ধূলা উড়ায় না। আমরা জোছনার রাত্রিতে খড়ের গাধায় লুকোচুরি খেলতাম। এখন ওসব গ্রামে আর নেই। পাড়ায় পাড়ায় ইট কংক্রিট আর লোহার দালান, ছেলেমেয়েরা পড়তে যায় ঠিকই কিন্তু আর খেলতে যায়না। এই সময়টাতে তারা কেউ কেউ মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত আবার কেউ কেউ নীল জগতে আবার কেউ কেউ দালালের ফাঁকফোকরে ছারপোকার মতোন লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করে। বাল্যকালের সে প্রম হয়ে দাঁড়ায় পরবর্তীকালের হতাশার কারণ।
আমার গ্রামকে আমি এখন আর খুব কাছ থেকে দেখতে পাই না, দেখতে পাই কিছু পশু আর কিছু মানুষ। আশ্চর্য হলেও সত্য পশুগুলোও দেখতে মানুষের মতো। তাই বলে মা মাটি আর গাঁ'য়ের প্রতি আমার প্রেম কমে যাইনি। আকাশসংস্কৃতি আর নীল জগতের কথা পরের অনুচ্ছেদে লেখার ইচ্ছা আছে।
শিক্ষিত জনসংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু শিক্ষিত মানুষ বাড়েনি। জনসংখ্যা রাত্রির নিস্তব্ধ খেলায় বাড়ানো যায় কিন্তু প্রকৃতি বড়ই নিদারুণ, রাত্রির খেলায় মানুষ বাড়ানোর ক্ষমতা প্রকৃতি দেয়নি। মানুষ হতে হয় ধাপে ধাপে, অনেকগুলো জীবনের স্তর পার করে মানুষ হতে হয়।
সকলের গ্রাম আবার সোনার মতোন হোক, ভালোবাসা হোক গ্রামের অন্তঃস্থলের পাথেয়।
১৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ইং
No comments:
Post a Comment