Tuesday, July 9, 2019

গল্প




















মিউজিক্যাল চেয়ার

                                       জয়দেব সাঁতরা

================================================

      ঘোষক মাইকে ঘোষনা করে চলেছে– ভারত মাতা প্রতিবাদী সংঘের পরিচালনায় সারাদিনব্যাপী যে ক্রীড়া এবং সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা চলছে তা শেষ পর্বে এসে পৌঁছেছে। এই পর্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতাটি হল– সর্বসাধারণ মহিলাদের জন্য মিউজিক্যাল চেয়ার। অংশ গ্রহণকারী মহিলাদের অতিসত্বর ক্রীড়া প্রাঙ্গণে উপস্থিত হওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
                মাইকে ঘোষণা শুনে মেয়েরা একে একে ক্রীড়া প্রাঙ্গণে উপস্থিত হতে থাকে। এই একটা দিন তারা মিউজিক্যাল চেয়ার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে খুব আনন্দ পায়। নিস্তরঙ্গ গ্রাম্য জীবনে তাদের অন্তরে খুশির ঢেউ ওঠে। এই দিনটার জন্য তারা সারা বছর মুখিয়ে থাকে। বৃত্তাকার ট্রাকে সারি সারি করে সাজানো চেয়ারগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে পুরস্কার জেতার জন্য মনে মনে সংকল্প করে। তারা অধীর আগ্রহে মিউজিক বাজার জন্য প্রতীক্ষা করে।
              অবশেষে পড়ন্ত বিকালে শুরু হয় মিউজিক্যাল চেয়ার প্রতিযোগিতা। অস্তাচলগামী সূর্যের শেষ রশ্মি টুকু গায়ে মেখে মেয়েরা মিউজিকের তালে তালে বৃত্তাকার ট্রাকে ঘুরতে থাকে। মিউজিক থামার সঙ্গে সঙ্গে এক এক করে প্রতিযোগিনীরা খেলা থেকে ছিটকে যেতে থাকে। ছিটকে যাওয়া প্রতিযোগিনীরা হতাশ হয়ে অন্যের খেলা প্রত্যক্ষ করে। আর টিকে থাকা প্রতিযোগিনীরা  নতুন উদ্যমে খেলতে থাকে। জমে ওঠে প্রতিযোগিতা।
               অদূরে দাঁড়িয়ে ভূদেব প্রত্যক্ষ করে এই খেলা। খেলা দেখতে দেখতে আনমনা হয়ে পড়ে সে। কত কথায় তার মনে পড়ে স্মৃতির ক্যানভাসে। ভেসে ওঠে জপার মুখ। মিউজিক্যাল চেয়ার খেলতে খুবই ভালবাসত সে। অথচ ঈশ্বরের দুনিয়ায় ঠাঁই হলো না তার ।অকালে চলে যেতে হল তাকে। মিউজিক্যাল চেয়ারের দুনিয়া থেকে চিরতরে ছিটকে পড়ল সে ।
            ভূদেব এর বয়স তখন কতই আর হবে,সবে বিয়ে হয়েছে তার জপার সঙ্গে। চাকুরীরত ভূদেবের শ্বশুরবাড়িতে খাতির ছিল খুব ।চার ভাইয়ের এক বোন। বাড়ির একমাত্র জামাই সে। ফলে আদর-যত্নের কোন অভাব ছিল না।
             ভূদেব এর মনে পড়ে জপার মিউজিক্যাল চেয়ার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের কথা। ফাগুনের এগারো, বারো, তেরো–এই তিন দিন ধরে তার শ্বশুরবাড়ির গ্রামে বসে পীরের মেলা ।এই মেলায় পাশাপাশি চার পাঁচ খানা গ্রাম রীতিমত উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে। মেলা প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে হিন্দু-মুসলমানের মিলন স্থল। যদিও এটি পীরের মেলা, তবুও এই মেলার সমস্ত দায়– দায়িত্ব পালন করেন হিন্দু মুসলমান সকলেই। সাম্প্রদায়িক হিংসা বিদ্বেষ তাদের কাউকে স্পর্শ করতে পারেনি। হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতির জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে এই পীরের মেলা।
           মেলার কদিন বাড়ি বাড়ি ভরে ওঠে কুটুম আত্মীয়-স্বজনদের সমাগমে। মেলাকে কেন্দ্র করেই তিন দিন ধরে বসে বিভিন্ন খেলাধুলার আসর। দৌড়, সাঁতার,স্লো সাইকেল রেস, যেমন খুশি সাজো, মিউজিক্যাল চেয়ার নানান– ধরনের খেলা এই মেলার মুখ্য আকর্ষণ। সকাল থেকে অনেক রাত্রি পর্যন্ত চলে এই মেলা। দূর দূরান্ত থেকে বহু দোকানদার আসেন তাঁদের জিনিস পত্রের পসরা নিয়ে। দোকানে দোকানে  ব্যস্ত মানুষ জনের কেনা কাটার ভিড় হয় দেখার মতো। এই মেলার মুখ্য আকর্ষণ মাটির তৈরি কালো কালসী। গ্রীষ্মের প্রারম্ভে মাটির তৈরি এই কালো কলসী কেনার জন্য লোকজনের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। নাগরদোলায় দোল খেতে খেতে আনন্দে হারিয়ে যায় প্রেমিক– প্রেমিকা ও নবদম্পতির দল।
               নির্দিষ্ট ক্রীড়াসূচী মেনে শুরু হয় বিভিন্ন ধরনের খেলা। দৌড় প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে খেলার শুভ আরম্ভ হয়। তবে সাঁতার প্রতিযোগিতাটি এখানে দেখার মত। কেবলমাত্র স্থানীয় প্রতিযোগিরাই এই খেলায় অংশগ্রহণ করেন না, অনেক দূর-দূরান্ত থেকেও সাঁতারুরা আসেন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে। যে সাঁতারু পরপর তিন বছর চ্যাম্পিয়ন হন তাকে একটি শিল্ড দিয়ে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা হয়। সাঁতারুও শিল্ড পেয়ে পরম আনন্দে বাড়ি ফিরে যান।
           প্রতিদিনের ঘোষিত ক্রীড়া সূচি অনুযায়ী খেলা চলতে থাকে। প্রতিযোগিতার শেষ পর্বে অনুষ্ঠিত হয় মিউজিক্যাল চেয়ার। গ্রাম ও গ্রামান্তরের মেয়ে বউরা এই খেলায় অংশগ্রহণ করে। এবারের প্রতিযোগিতায় নববিবাহিতা জপাও নাম লেখায়। বরাবরই খেলাধুলার প্রতি তার আগ্রহ খুব বেশি। স্কুলে পড়ার সময় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সে অংশগ্রহণ করেছে ।তাই নতুন উদ্যমে নতুন ভাবে খেলা শুরু করে সে। মিউজিক্যাল চেয়ার প্রতিযোগিতায় মিউজিক বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় খেলা। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী মহিলারা বৃত্তাকার মিউজিকের তালে তালে ঘুরতে থাকে ।চতুরতার সঙ্গে সকলেই খেলতে থাকে। তবুও এক এক জনকে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে যেতে হয়। শেষ পর্যন্ত যে তিনজন প্রতিযোগিতায় নিজেদেরকে খেলার মধ্যে রাখতে পারে জপা তাদের একজন‌। কিন্তু জপার খেলাও আর বেশি দূর গড়ালো না। তিন নাম্বার পজিশনে তাকে খেলা শেষ করতে হয়। প্রতিযোগিতায় প্রথম হয় জিনিয়া আর দ্বিতীয় হয় ত্রিবেণী।
           তিনদিনের সমস্ত খেলা শেষ হবার পর শুরু হয় পুরস্কার বিতরণী সভা।সভা মঞ্চে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন এলাকার স্থানীয় বিধায়ক। বিশেষ অতিথির আসন অলংকৃত করেন জপার স্বামী ভূদেব। শুরু হয় একে একে পুরস্কার বিতরণ। বিজয়ী প্রতিযোগীদের হাতে পুরস্কার গুলি তুলে দিতে থাকেন মঞে উপবিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। পরপর পুরস্কার গুলি তুলে দেবার পর আসে জপার পুরস্কার নেওয়ার পালা। জপা একবার উপস্থিত দর্শকদের দিকে আর একবার মঞ্চে উপবিষ্ট ভূদেব এর দিকে তাকাতে থাকে। ঘোষক মাইকে ঘোষণা করেন এবার মিউজিক্যাল চেয়ারে তৃতীয় স্থান অধিকারী জপার হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন আজকের বিশেষ অতিথি মাননীয় ভূদেব বাবু।
                ঘোষণার পর জবা পুরস্কার নিতে মন চাচ্ছে চোখে মুখে তার একটা আলাদা তৃপ্তির হাসি ভূদেব হাসি হাসি মুখে জবার হাতে পুরস্কার তুলে দেয় পুরস্কার নিয়ে জবা হাত বাড়িয়ে দেয় ভূদেব এর দিকে করমর্দন করতে করতে ভূদেব জবার দিকে তাকিয়ে দেখে চোখ দুটো তার আনন্দে জ্বলজ্বল করছে। এই স্মৃতি ভূদেব ভুলতে পারে না কোনদিন।
              ঢাকের আওয়াজে ভুতের সম্বিৎ ফিরে পায় ক্রেটা প্রাঙ্গণে দিকে তাকিয়ে দেখে তখন মিউজিক্যাল চেয়ার প্রতিযোগিতাটি সবেমাত্র শেষ হয়েছে খেলায় পুরস্কার বিজয়ী মেয়েরা হৈ হুল্লোড় করতে করতে সরস্বতী পূজা মন্ডপ এর দিকে যেতে থাকে আলোয় ঝলমল করছে পূজা মন্ডপ ঢাকি তার ধাকে সন্ধ্যারতির বোল তুলেছে ছেলে মেয়ের দল দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে ঢাকের তালে ব্রাহ্মণের সন্ধ্যারতি।
             শূন্য মিউজিক্যাল চেয়ার প্রাঙ্গণে ভূদেব একাকী দাঁড়িয়ে থাকে। শূন্য চেয়ারগুলোর দিকে তাকিয়ে আজ শুধু সে একজনকেই যেন দেখতে পায়। জপা যেন শেয়ারগুলোর চারিদিকে একাকী ঘুরছে। কোন চেয়ারটা দখল করবে সে ভেবে ঠিক করতে পারছে না। অথচ ভূদেব তাকে কিছু বলতেও পারছে না। সবই যেন তালগোল পাকিয়ে যায় তার। হৃদয়টা তার দুমড়ে মুচড়ে ওঠে। খেয়াল করেনি কখন তার 
চোখ দুটো জলে ভরে গেছে।




•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••
গ্রাম– কাঁটাগোড়িয়া
পোস্ট– সিংড়াপুর
থানা– গোঘাট
জেলা– হুগলী
পিন কোড– 712 614

No comments: