Saturday, April 27, 2019

প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য শিল্পে ঐতিহ্যবাহী টেরাকোটা শিল্প
   -নৃপেন্দ্রনাথচক্রবর্তী



একটি দেশ ও জাতির অভিজ্ঞান ধরা পড়ে তার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে । সমাজ বদ্ধ মানুষের গৌরবগাথা তার সংস্কৃতি। সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই দেশ ও জাতির পরিচয় ফুটে ওঠে। ব্যুৎপতি গত অর্থে সংষ্কার শব্দ থেকে সংস্কৃতি শব্দের উৎপতি। একটি সমাজের লোকসংস্কার, লোকনৃত্য, লোকসংগীত, লোকশিল্প, লোকআচার, লোকসাহিত্য প্রভৃতিকে ঘিরে লোক সংস্কৃতি তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ভাস্কর। দেহমন আত্মার অনুশীলনলব্ধ উৎকর্ষই হচ্ছে সংস্কৃতি। এর সঙ্গে “লোক” যুক্ত হয়েছে “লোকসংস্কৃতি” লোক বলতে সাধারণত গ্রামীণ সমাজের বা লোকায়ত সমাজের জনসাধারণকে বোঝনো হয়েছে। এ লোক সমাজের জনগন অনেকেই নিরক্ষর হলেও অশিক্ষিত নয়। অক্ষরজ্ঞানহীন হলেও পারস্পরিক যোগাযোগ ও ভাবের আদান প্রদানে তারা বেশ সমৃদ্ধ। এই লোকায়ত মানুষেরই সামগ্রিক মননের সার্থক অভিজ্ঞান লোকসংস্কৃতি। সংস্কৃতির একটি ধারা লোকশিল্প লোকায়ত সমাজ জীবনের বিচিত্র। ঐশ্বর্য বহুকাল থেকেই গৌরব ধন্য। টেরা কোটা তেমনি একটি লোক শিল্প। টেরা কোটা ইতালির শব্দ যুগল। টেরা অর্থ মাটি এবং কোটা অর্ধদগ্ধ তাই টেরাকোটা হচ্ছে পোড়ামাটির শিল্প। আমাদের বাংলাদেশের পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, ময়নামতি এসব স্থানে এ শিল্পের বহু নিদর্শন শিল্প রসিকদের প্রশংসা কুড়িয়ে আসছে বহুকাল থেকেই। এসব স্থানে যে শিল্প নিদর্শনগুলো দেখা যায় সেগুলো হচ্ছে রাধাকৃষ্ণ, নারীমূর্তি, বলরাম, বৌদ্ধজাতক, রাম, গাড়ি, রামায়ন-মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনীর দৃশ্যাবলী, করুক্ষেত্র যুদ্ধের কাহিনী, রাম-রাবনের কাহিনী, বিবাহের দৃশ্যাবলী, জলে ভেসে হাসসহ বিভিন্ন ধরণের খেলনা ইত্যাদি। এছাড়াও এসব টেরাকোটায় দৃশ্যমান রাম-রাবণ, রাধাকৃষ্ণ, শিব-দূর্গা, কালী-সরস্বতী, লক্ষ্মী-নারায়নসহ বিভিন্ন ফুল-ফল-পাতা, পালকি আর পশুপাখির মূর্তি। এগুলো বেশির ভাগই ছাঁচে তৈরি। কোন কোন মূর্তি আবার হাতের ও তৈরি। আমাদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় মন্দির-মসজিদে এ সব নিদর্শন রসিকজনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমাদের দেশের রাজশাহী, দিনাজপুর, নাটোর, পাবনা ফরিদপুর, যশোহর, বরিশাল, কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, রংপুর, কুমিল¬া, চট্রগ্রাম প্রভৃতি স্থানে এসব শিল্প নিদর্শনগুলো দেখা যায়। পোড়ামাটির এসব শিল্পকর্মে রঙের ব্যবহার খুবই চোখে পড়ে। পোড়ামাটির এসব শিল্প কর্মবাংলার লোক সমাজের লোকায়ত ভাবনা এক অনুপম অভিজ্ঞান হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত। পোড়ামাটির প্রতœ নির্দশনগুলো সাধারণত তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে যথা ১. আদিপর্ব ২.মধ্যপর্ব ৩. সমকালীন পর্ব। আদি পর্বও মধ্যপবের্র নিদর্শনগুলোর সঙ্গে আধুনিক পর্বের নিদর্শনগুলির পার্থক্য বিদ্যমান। প্রাচীন ও মধ্য পর্বেও পোড়ামাটির কাজে স্থুল রুচির দেখা মিললেও আধুনিক পর্বে তা অনুপস্থিত। আধুনিক কালের শিল্পীদের শিল্পকর্ম সূক্ষ্ম ও মসৃণ। আমাদের দেশের নিদর্শন মেলে নবম শতাব্দীর পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহারে। দেশের অনেক জায়গায় পাথর দুষ্পাপ্য। ফলে লোক শিল্পীরা সহজ প্রাপ্য মাটির ওপর র্নিভর করেছে স্বাভাবিক ভাবেই। লোক শিল্পীরা হাতের কাছে পাওয়া মাটি দিয়ে বিভিন্ন মূর্তি তৈরি করে শুকানের পর তা রং করেছে এবং শিল্পকর্মগুলোকে স্থায়িত্ব দান করার জন্যই পরে পোড়ানো হয়েছে। এর ফলে পোড়ামাটির শিল্প কর্ম পেয়েছে দীর্ঘস্থায়ী এক রূপ। লোক শিল্পীরা প্রস্তর শিল্পকলানুগ রীতির অনুশাসনে আবদ্ধ না থেকে নিজেদের স্বাধীন ও মুক্ত চিন্তার আলোকে মনের তাগিদে তৈরি করেছে এসব পোড়ামাটির নানা পুতুল ও মূর্তি। মুসলিম শাসনের পূর্ব থেকেই বাংলায় এ শিল্পের প্রচলন ছিল। বাংলাদেশে মুসলিম অধিকারের পূর্ববতী পর্বেও পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, ময়নামতি ফলকগুলির মাধ্যমে এদেশের শিল্পীদের যে টেরাকোটা বা পোড়া মাটি শিল্পে পূর্ণ অধিকার ছিল তার সমর্থন মেলে। এপর্বের যে ক’টি ইটের মন্দির বা মসজিদ এখনো বর্তমান তার মধ্যে ফরিদপুরের মথুরাপুরের দেউল (১৭০০) একই জেলার ভাঙ্গা উপজেলার পাতরাইলের আউলিয়া মসজিদ (১৪০০) দিনাজপুরের কান্তনগরে কান্তাজীর মন্দির (১৭২২) বরিশালের কবি বিজয় গুপ্তের মনসা মন্দির (১৫০০) মাদারীপুরের খালিয়া রাজারাম মন্দির (১৭০০ ) সিরাজগঞ্জের নবরতœ মন্দির (১৭০০) কুমিল্লার শালবন বৌদ্ধ বিহার (৮০০-১১০০) পাবনার জোড় বাংলা মন্দির (১০১৪) বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ (১৫০০) গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের নবরতœ মন্দির (১৪০০ ) গৌড়ের ছোট সোনা মসজিদ (১৪৯৪-১৫১৯), নড়াইলের কালিয়ার জগ্মনাথ দেবের রথ (১৬০০), বড়ই বাড়ি ঢোল সমুদ্র (১৩০০) কুটিলা মুড়া, পানজোরা গীর্জা (১৬৬৩), দিনাজপুরের নওয়াবগঞ্জ সীতা কোট বিহার, মুন্সিগঞ্জের শ্যাম সিদ্ধ মঠ ( ১৭৫৮) রাজশাহী বাঘা মসজিদ, বগুড়ার বিবিচিনি শাহী মসজিদ (১৭০০), বড় সোনা মসজিদ (১৫০০), বিক্রমপুরের বাবা আদম মসজিদ (১৬৭৯) মানিকগঞ্জের মওের মঠ (১৭০০) যশোরের চাচড়ার মহাবিদ্যা মন্দির, রাজশাহীর বিড়ালদহ মাজার, কুষ্টিয়ার ছোট আহুক মন্দির, নবাবগঞ্জের খেলারাম দাতার মন্দির (১৯০০) সোনার গায়ের ইব্রাহিম দানিশ মন্দের মাজার, চাপাই নবাবগঞ্জের ছোট সোনা মসজিদ (১৪০০) সিরাজগঞ্জের হাটি কুমরুলের দোল মঞ্চ, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার লসমা রাজবাড়ী, মাগুড়ার মোহাম্মদপুর উপজেলার রামঠাকুরের মন্দির, মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ি উপজেলার নাটেশ্বরের দেউল (৯৮০-১০৫৪) প্রভৃতি। চর্তুদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলার বহু মসজিদে ও মন্দিরে টেরাকোটার শিল্পকর্ম দেখা যায়। এগুলোর মধ্যে আউলিয়া মসজিদ, গৌড়ের ছোট সোনা মসজিদ, বিবিচিনি শাহী মসজিদ, বাবা আদম মসজিদ, বাঘা মসজিদ, পাবনার জোড়বাংলা মন্দির, কাজে টেরাকোটার অলংকরণ দেখা যায়। বাংলার পোড়ামাটির মন্দির ভাস্কর্য ও স্থাপত্য শিল্পরীতিকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের প্রথম যুগ, অষ্টাদশ শতকের মধ্যযুগ এবং উনিশ শতকের নব্যযুগ, প্রথম যুগের মুর্তিগুলোকে সরাসরি স্থাপন না করিয়ে পাশ থেকে দেখানো হয়। এসব মূর্তি অঙ্গ-প্রতঙ্গের সন্ধিস্থলগুলো গভীর ও সূক্ষ্ম ভাবে খোদাই করা। এগুলোর নির্দশন দেখা যায় উজান নগরীর উজানী রাজরাড়ী, মুকসুদপুরের নবরতœ মন্দির ইত্যাদি। মধ্যযুগের মূর্তিগুলোর রীতি অনেকটা শিথিল। আর নব্য যুগের দিকে দৃষ্টি দিলে এ শিল্পরীতিতে ইউরোপীয় প্রভাব দেখা যায়। ইউরোপীয় প্রভাব পড়ায় এ যুগের অনেক শিল্প লোকজ প্রভাব অন্তর্হিত। এখানে স্থান করে নিয়েছে সামরিক পোশাক-পরিচ্ছদ সাহেবিয়ানা এবং দৈনন্দিন জীবন-যাপনের চিত্র। খুব মজার বিষয় যে, এসব মৃৎ ভাস্কর্যে এখন পর্যন্ত কোন লোনা ধরেনি। এখান থেকে বিষয়টি স্পষ্ট যে, লোক শিল্পীদের মাটি চিনে নেবার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। বিজ্ঞান সম্মত জ্ঞান না থাকলেও তাদের জ্ঞানদৃষ্টি সকলের প্রশংসা পাবার যোগ্য। মাটি ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড, ফেরিক ক্লোরাইড প্রভৃতি উদগ্রাহী যৌগের উপস্থিতি লোনা ধরায়। যে মাটিতে উক্ত যৌথ থাকে, সেখানে লোনা ধরতে পারে না। শিল্পীরা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চোখ দিয়ে মাটি নির্বাচন করে তা দিয়ে শিল্প তৈরি করার পরে সেগুলোকে ভাটি বা পোনে একটি নির্দিষ্ট তাপ মাত্রায় পুড়িয়ে তৈরি করেছেন এসব নান্দনিক মূর্তি। মৃৎ-শিল্পীরা তাদের টেরাকোটায় মূর্তি নির্মাণ করতে গিয়ে বিভিন্ন বিষয়কে আশ্রয় করেছেন। এর মধ্যে পুরানকে কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে রামায়ন-মহাভারত ও রাধা কৃষ্ণের লীলা বিষয়ক রামায়ন ও কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের কাহিনীর নানান মূর্তি। লোকায়ত জীবনকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে গৃহ সাজ-সজ্জার নানা উপকরণ ফল-ফুল, পুতুল, হাড়ি-কলসি, লতা পাতা, ঘট বিভিন্ন মুখোশ ইত্যাদি। বিভিন্ন ভঙ্গীতে নারী মূর্তি কর্মকেন্দ্রিক জীবনের নানা দৃশ্য, পশুপাখি কেন্দ্রিক নানা পুতুল হাতি, ঘোড়া, উট, ময়ুর, গরু, হরিণ, ভালুক, বিড়াল, বাঘ, সিংহ ইত্যাদি। এছাড়াও দেখা যায়, সংগীত কেন্দ্রিক নানা যন্ত্র হারমনিয়াম, তানপুরা, খোল-করতাল, তবলা-ডুগডুগি, বাঁশি-বেহালা ইত্যাদি। কোন কোন মূর্তিতে অসংস্কৃত ভঙ্গিমাও লক্ষণীয়। এসব মূর্তি তৈরির পিছনে শিল্পীরা আদিম যাদু বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে বলেই মনে হয়। শিল্পীরা অনেক সময় মনের তাগিতে তাদের শিল্প কর্ম তৈরি করেন। তাই অনেক ক্ষেত্রে সেই নির্দিষ্ট নিয়ম পালন করা যায় না। বাধা-ধরা কোন নিয়মই শিল্পীর স্বত:স্ফূর্ত আবেগকে নির্দিষ্ট পথে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত জীবনের লোকজীবনকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে গৌরবমন্ডিত টেরাকোটা শিল্প। শিল্প তার নিজস্ব গুণেই প্রাচীনকাল থেকে অদ্যবধি টিকে থাকবে ততকাল পৃথিবী টিকে থাকবে যতকাল।
লেখক : নৃপেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, পুরাকীর্তি গবেষক /মুক্ত ফিচার লেখক ও কবি।
৪৫, বৃন্দাবন বসাক  স্টিট , কোলকাতা-৭০০০০১
ই- মেল-cb nripen 921@ gmail.com
                           হোয়াটস অ্যাপ –7718298921
                            ফোন-+91-7718298921

No comments: