Tuesday, September 29, 2020

সীমান্ত হত্যার পরিসংখ্যান 2020

 সীমান্ত হত্যার শেষ কোথায় 

শাবলু শাহাবউদ্দিন 


অবসর প্রাপ্ত মেজর সিনহার হত্যার মাধ্যমে হয়তো বন্দুক যুদ্ধ নামক কালো এক বিচার বহির্ভূত হত্যার অধ্যায় শেষ হতে চলেছে আমার সোনার বাংলাদেশে । কিন্তু সীমান্ত হত্যার শেষ কোথায়? আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র ভারত প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের সাধারণ কৃষক এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সীমান্ত এলাকায় থেকে বিচার বহির্ভূত হত্যা করছে চলছে । নির্বিচারে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ( বিএসএফ ) গুলিতে প্রতিবছর ডজন খানেক বাংলাদেশী নাগরিক মারা যাচ্ছে । যা বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের কাছ থেকে কখন আমরা প্রত্যাশা করি না । ভারতের শত্রু রাষ্ট্র পাকিস্তান কিংবা চীন, তাদের সীমান্ত কখন তো একজন ভারত, পাকিস্তান কিংবা চীনের সাধারণ নাগরিক গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে না । এমন কি ভারতের সীমান্তবর্তী দেশ নেপাল,ভুটান, মায়ানমার তাদের সীমান্তে সাধারণ নাগরিক খুব শান্তিতে বসবাস করতে পারলে, আমরা বন্ধু রাষ্ট্র বাংলাদেশ কেন ভারতের  বিএসএফের বিরাগভাজন হচ্ছি এবং প্রতিনিয়ত গুলি খেয়ে মরছি । নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে আবার বলা হচ্ছে, এরা সাধারণ নাগরিক না, এরা সন্ত্রাস । বাস্তবতা কিন্তু তা বলে না, যত সন্ত্রাসী কী বাংলাদেশের নাগরিক? প্রশ্ন একটাই বিএসএফের গুলিতে কেন শুধু বাংলাদেশের নাগরিক মরে ? ভারতের সীমান্তবর্তী সন্ত্রাসীরা কেন মরে না । এ যাবৎ কালে বিএসএফের গুলিতে যত বাংলাদেশি নাগরিক মারা গেছে প্রকৃত পক্ষে তারা বাংলাদেশ সাধারণ কৃষক কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী । তাহলে ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) গুলি করে হত্যা করে কেন বাংলাদেশি নাগরিকদের সন্ত্রাস বলছে ? আমরা যদি ভারতের বন্ধু রাষ্ট্র হয় তাহলে ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীরা আমাদের বন্ধু । কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তার বিপরীত, ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী আমাদের নাগরিকদের নির্বিচারে গুলে করে তাঁরাই প্রমাণ করছে আমরা তাদের শত্রু । আমরা তাদের বন্ধু রাষ্ট্র ভাবলেও, তাদের ব্যবহার পাচ্ছি শত্রু রাষ্ট্রের মত । নাকি আমাদের বুঝায় ভুল হচ্ছে । সত্য হচ্ছে যে তারা আমাদের বন্ধু কিন্তু আমরা তাদের শত্রু । 

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের(আসক) হিসেবে ২০১৯ সালে সীমান্তে ৪৩ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে গুলিতে ৩৭ জন এবং নির্যাতনে ছয় জন। আহত হয়েছেন ৪৮ জন। অপহৃত হয়েছেন ৩৪ জন। ২০১৮ সালে নিহত হয়েছেন ১৪ জন। আর ২০১৭ সালে ২৪ জন।সরকারি হিসাবে এক বছরে সীমান্ত হত্যা ১২ গুণ বেড়েছে বাংলাদেশ ।নানা প্রতিশ্রুতির পরও সীমান্ত হত্যা কমছে না। আর গত তিন বছরের হিসাবে সবচেয়ে বেশি সীমান্ত হত্যা হয়েছে গত বছর (২০১৯)৷ ২০২০ সালের ঠিক একই রকম চলছে ।

পশ্চিমবঙ্গ-ভিত্তিক ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠন, মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) প্রধান কীরিটি রায় বলেন, ‘‘আগে বিএসএফ বলতো আমাদের ওপর আক্রমন করতে এলে আমরা আত্মরক্ষার্থে গুলি করেছি। লাশ ফেরত দিতো। এখন আর তাও বলেনা। গুলি করে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেয়। ফেরতও দেয় না।''


তিনি বলেন, ‘‘ভারত তো একটা হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তারা তো সীমান্ত হত্যা বন্ধ করবেনা। সীমান্তে মুসলমানদের মারছে। আর ঠেলে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। আমরা প্রতিটি ঘটনার প্রতিবাদ করছি। কিন্তু ভারত হত্যা করবেই সে থামবে না। তারা মারছে তো মারছেই। কিন্তু বাংলাদেশের দিক দিয়ে শক্ত কোনো প্রতিবাদ দেখতে পাচ্ছিনা। মেরে দিচ্ছে কোনো বিচার নাই।''

বিগত ১০ বছরে প্রায় ১,০০০ মানুষ ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক নিহত হয়, যার বেশিরভাগই বাংলাদেশি। সীমান্ত এলাকাকে একটি দক্ষিণ এশিয়ার হত্যার ক্ষেত্রে পরিণত করে। অনেক ক্ষেত্রে নিরস্ত্র এবং অসহায় স্থানীয় বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যাকাণ্ডের পরিষ্কার প্রমাণ সত্ত্বেও, এখন পর্যন্ত কাঊকেই হত্যাকাণ্ডের জন্য অভিযুক্ত করা হয়নি।

মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের রেকর্ড অনুযায়ী ২০০০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গত ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১০৬৪ জন বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে বিএসএফ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুসারে ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে বিএসএফ গুলি ও শারীরিক নির্যাতনে হত্যা করেছে ৪২ জন বাংলাদেশিকে। অন্য একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সীমান্তে ৩শ ১২ বার হামলা চালানো হয়। এতে ১২৪ জন বাংলাদেশী নিহত হয়। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে ১৩০টি হামলায় ১৩ জন নিহত, ১৯৯৭ সালে ৩৯টি ঘটনায় ১১ জন, ১৯৯৮ সালে ৫৬টি ঘটনায় ২৩ জন, ১৯৯৯ সালে ৪৩টি ঘটনায় ৩৩ জন, ২০০০ সালে ৪২টি ঘটনায় ৩৯ জন নিহত হয়।

জাতীয় মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব অনুসারে ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিএসএফ হত্যা করেছে ৩৫ জনকে। এ সময় বিএসএফ ২২ বাংলাদেশীকে গুলি ও নির্যাতন করে আহত করেছে আর অপহরণ করেছে ৫৮ জনকে ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে মাত্র ৭ দিনের ব্যাবধানে ভারতীয়রা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ৩ বাংলাদেশীকে জোর-জবরদস্তি অপহরণ করে নিয়ে গেছে।

বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালে মোট ২৭ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ সদস্যরা৷ ২০১৪ সালে হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জন বাংলাদেশিকে৷ আহত হয়েছেন ৬৮ জন৷ এছাড়া বিএসএফ ধরে নিয়ে গেছে ৫৯ জনকে৷   ২০১৫ সালে বিএসএফ হত্যা করেছে ৪৫জন বাংলাদেশিকে৷

২০২০ সালের প্রথম ৬ মাসে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোতে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যমতে, জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ২৫ জন বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে ভারতীয় বিএসএফ। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরেও থেমে নেই এই হত্যাকাণ্ড। ভারতের সাথে সম্পর্কের উন্নতি ঘটলেও তার প্রতিফলন মেলে না সীমান্তে, এমনকি সামগ্রিক প্রেক্ষাপটেও। দু-দেশের আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় যে, বিএসএফ নন-লেথাল (প্রাণঘাতী নয়) অস্ত্র ব্যবহার করবে। যাতে করে সীমান্তে হত্যা শূণ্যতে নামিয়ে আনা যায়। কিন্তু তারপরেও কেন এতো হুজ্জতি করে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার?

সীমান্ত হত্যা এভাবে চলতে পারে না । বাংলাদেশ এবং ভারত সরকারের এখনি উচিত সঠিক সমাধান খুঁজে বের করে, সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা । তা না হলে অতিদ্রুত দুই দেশ মধ্যে বন্ধুত্বের ফাটল ধরে যেতে পারে । 




শাবলু শাহাবউদ্দিন 

কবি ও লেখক 

বাংলাদেশ তরুণ কলম লেখক ফোরাম

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় 

পাবনা-বাংলাদেশ ।

Sablushahabuddin@gmail.com 

+8801746631125

No comments: