Sunday, March 22, 2020

Jawad tahshin এর ছোট গল্প

গল্পঃ ঊনমৃত্যু

পর্বঃ ১

রাত ৩.০০ বাজে। রুমের লাইট বন্ধ। তবে রুম একেবারেই অন্ধকার না। রাস্তার সোডিয়াম বাতি জ্বলছে। তার কিছুটা আভা বারান্দা দিয়ে এসে পড়ছে। পুরো রুমে হলদে একটা ভাব। হলদে আলো আর নিকষ অন্ধকার মিলে অদ্ভুত এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। রিয়া শুয়ে আছে বিছানায়। তার পাশে ঘুমুচ্ছে রবিন। বেচারা অফিসে অনেক চাপে আছে। অনেক রাত করে টায়ার্ড হয়ে বাসায় ফিরে।তাদের মাঝখানে শুয়ে আছে তাদের মেয়ে নিশাত। মেয়েটিও ঘুমোচ্ছে। অনেক কষ্টে তাকে ঘুম পাড়ানো গেছে। রিয়ার একা একা লাগছে। ঘড়ির টিক টিক শব্দ কানে আসছে। বাথরুমের নল থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ার শব্দ আসছে। পানির শব্দ, ঘড়ির শব্দ, হালকা সোডিয়ামের আলো চারপাশ রহস্যময় করে রেখেছে। রিয়া এই অবস্থায় একা থাকলে হয়তো অনেক ভয় পেতো।কিন্তু এখন পাশে রবিন আর নিশাত আছে বলে ভয় পাচ্ছে না খুব একটা। রিয়া মৃদু স্বরে ডাকে- 
"রবিন?"
কোনো সাড়া নেই। রিয়া হালকা ধাক্কা দেয় রবিনের গায়ে। 
"রবিন?"
"হু"
"ঘুমাচ্ছো?"
"হু"
"আমার না একা একা লাগছে!"
"হু"
 "আমি তোমাকে এখন বিছানা থেকে তুলে নিয়ে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেব।"
"হু"
"তোমাকে কামড় দিব একটা।"
"হু"
রিয়া নিশ্চিত হয়, যে রবিন ঘুমের ঘোরে "হু হু" করছে। বেচারা ঘুমোক। অনেক কষ্ট করে সারাদিন। 
হঠাৎ রিয়ার কানে পায়ের শব্দ আসে। কেউ একজন হাঁটছে। শব্দটা আসছে ডাইনিং রুম থেকে।তার কানে হঠাৎ ফ্রীজ খোলার শব্দ এলো। চমকে উঠলো সে। কয়েকসেকেন্ড পর  গ্লাসে পানি ঢালার শব্দও কানে আসলো। রিয়া বিছানা থেকে উঠে। গুটি গুটি পায়ে এগুতে থাকে। তার গায়ে হলুদ আলো এসে পড়ছে বাইরে থেকে। সে একবার বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকায়।  আশে পাশে সব বিল্ডিং এর লাইট অফ। রিয়া সামনে এগুতে থাকে। হেঁটে হেঁটে ডাইনিং এ চলে আসে। একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পায়। মূর্তিটা স্থির দাঁড়িয়ে। রিয়ার বুকটা কেঁপে উঠে। কাঁপাকাঁপা হাতে সে লাইটের সুইচ দেয়ার জন্য দেয়ালে হাত দেয়। তার শরীর ঘামাচ্ছে। সে লাইটের সুইচটা কোনো রকমে অন করে! দেখে তার সামনে নাফিসা দাঁড়িয়ে! কিন্তু মেয়েটা না ঘুমিয়ে হাঁটছে কেন? 
"উফফ.. নাফিসা! তুমি?" 
"হু.. আমি! কেন? কি সমস্যা?"
"কোনো সমস্যা নেই। তুমি এখানে কেন?"
"থাকতেই তো পারি এখানে! থাকতে পারি না?"
"অবশ্যই.. অবশ্যই.."
" কি অবশ্যই আবার?"
" নাফিসা! তুমি এভাবে কথা বলো কেন?" 
"আমি কীভাবে কথা বলি?" 
"কেমন ভাবে যেন.."
"কেমন ভাবে মানে আবার কীভাবে?"  
"উফফ.. বিরক্তিকর!"
"কি বিরক্তিকর?"
রিয়া এবার হাল ছেড়ে দেয়। বলে,
"যেটা বলছিলাম, হুটহাট রাত বিরাতে এভাবে ডাইনিং এ ঘুরলে তো ভয় লাগে! আমি তো তোমাকে ভূত মনে করেছিলাম!"
নাফিসার মুখে একটা কৌতুকের হাসি দেখা যায় এবার।
 "ভূত? হাহাহা...ভালো বলেছো।"
রিয়া একদৃষ্টিতে নাফিসার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর মিনমিন করে বলে, "আমার কথা বাদ দাও। আমার নিশাত তো এখনো ছোট.. ও তো ভয় পেতে পারে!"
নাফিসার মুখ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে আসে। সে বলে, "নিশাত আমাকে দেখে কখনোই ভয় পাবে না। কিন্তু তোমাকে বা রবিনকে দেখে ভয় পেতেই পারে! হাহাহাহা... "
কি সব বলছে মেয়েটা? রিয়া চিন্তা করে। নাফিসা মেয়েটা আসলে এমনই। অদ্ভুত। রহস্যময়। রিয়া বলে, 
"চা খাবে নাফিসা?"
"খাওয়া যায়.."
" চা খেলে চা বানাতে হবে.."
"ওহ.. চা খেলে চা বানাতে হবে? আমি তো জানতাম-ই না.. খুবই জ্ঞানের কথা বলেছেন।আপনি মহাজ্ঞানী। আসসালামু আলাইকুম।"
"নাফিসা, তুমি এভাবে কথা বলো কেন জানতে পারি?"
"আমি কিভাবে কথা বলি?"
রিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বলে, "আমি চা বানিয়ে আনি। তুমি বসো।"
রান্নাঘরে যায় সে। চুলোয় পানি বসায়। চা পাতা ঢেলে দেয়। পেছনে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। নাফিসা রান্নাঘরে আসছে। 
"নাফিসা, চায়ে চিনি কয় চামচ দিব?" 
হঠাৎ এক পুরুষ কন্ঠ ভেসে আসে। 
"রিয়া.. রাত বিরাতে রান্নাঘরে কি করছো? আর কার সাথে কথা বলছিলে?" 
রিয়া চমকে উঠে। পেছনে রবিন দাঁড়িয়ে। 
"রবিন? উঠে গেছো? আমি চা বানাচ্ছিলাম।"
"দেখতেই পাচ্ছি চা বানাচ্ছো..।কিন্তু কার সাথে কথা বলছিলে?" 
রিয়া কোনো উত্তর দেয় না। রবিন হেঁটে এসে চুলো বন্ধ করে দেয়। বলে, "রিয়া.. ঘুমোতে যাও। আমি আসছি।"
রিয়া কিছু বলে না। হেঁটে হেঁটে রুমে যায়। রবিন বাসাটা একবার চেক করে। বাসায় কেউ নেই। ড্রইং রুম, বেলকনি, লিভিং রুম.. কোথাও কেউ নেই। তবে একটা জিনিস খটকা লাগে তার। ডাইনিং টেবিলে আধাগ্লাস ঠান্ডা পানি। ঠান্ডা পানি কে খেলো? রিয়া তো ঠান্ডা পানি খায় না! তার টনসিলের সমস্যা। তার উপর রিয়ার ঠান্ডা পানি পছন্দও না। রবিন চিন্তাটা জোর করে মাথা থেকে সরিয়ে ফেলতে চায়। সে রুমে ঢুকে। রিয়া বিছানায় শুয়ে আছে।রবিন বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে। রিয়ার দিকে তাকায় সে। মেয়েটা উপরে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে। রবিন বলে, 
"রিয়া.. আরো একটু কাছে এসো?" 
"নাহ.. মাঝখানে নিশাত ঘুমোচ্ছে।"  
"নিশাত? নিশাত আবার কে?"
রিয়া কোনো উত্তর দেয় না..। সে এখনো উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। রবিন আশেপাশে তাকায়। আসলেই আশেপাশে কেউ নেই। পুরো বাসায় সে আর রিয়া একা! রবিন হা করে রিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
 আবার জিজ্ঞাসা করে, "রিয়া.. সবকিছু ঠিকঠাক?" 
কোনো জবাব আসে না। রিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। হালকা সোডিয়াম আলোয় তাকে অপরূপ লাগছে দেখতে।

২. 
আসজাদ শরীফ চশমার ফাঁক দিয়ে সামনে বসা দুইজন মানুষকে দেখছেন। তিনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। ৪০ বছর বয়সী শক্তগড়নের লোক। ফর্সা, লম্বা,  চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা। তার সামনে বসে আছে রিয়া এবং রবিন। আসজাদ সাহেব বললেন, "রবিন সাহেব, একটু পাশের রুমে যাবেন প্লিজ? আমি পাঁচটা মিনিট আপনার মিসেস এর সাথে কথা বলি?" 
রবিন উত্তর দিল, "অবশ্যই.." 
রবিন উঠে চলে গেলো। আসজাদ সাহেব রিয়ার সামনে এসে বসলেন।   
"হ্যালো, রিয়া।"
"হ্যালো.."
"তোমার কেইসটা খুব ইন্টারেস্টিং.. রবিন বলছিলো তুমি নাকি মরা মানুষদের দেখতে পাও?" 
"না, পাই না। রবিন যা বলছে তা আপনি বিশ্বাস করবেন কেন? আপনি নিজে কখনো ভূত দেখেছেন?"
"না.. দেখি নি। তবে রবিনের কথা শুনে যা বোঝলাম সে সত্য বলছে।"
"ডাক্তার সাহেব? শোনা কথায় কান দিবেন না। আপনি নিজে যদি চোখের সামনে ভূত দেখেন, ভূত যদি আপনাকে এসে বলে, 
'আসজাদ সাহেব, আসসালামু আলাইকুম'! ভালো আছেন? শরীর ভালো?' তখনই বিশ্বাস করবেন ভূতের কথা। তার আগে না।"
আসজাদ সাহেব অবাক হলেন। কোনো রোগী তো এইভাবে কথা বলে না। তিনি বললেন, 
"বাব্বাহ..আপনি তো দেখছি অনেক স্মার্ট!"
রিয়া গটগট করে উত্তর দিলো, "জ্বি না। আমি স্মার্ট না। আমি জ্ঞানী। মহাজ্ঞানী। এজন্য এবার আপনি আমাকে সালাম দিন।"
আসজাদ সাহেব থতমত হয়ে মিনমিন করে বললেন, "আসসালামু আলাইকুম।" তিনি খুবই অবাক হয়েছেন। তারপর বললেন, " আপনি এভাবে কথা বলেন কেন?" 
রিয়া বললো, "এভাবে নাফিসা কথা বলে।"
"নাফিসা কে?" 
"আমাদের বাসার পাশের এক মেয়ে ছিলো।"
"ছিলো মানে? এখন নেই?" 
"না।  নেই। মারা গেছে। "
"রিয়া, আপনি কি নাফিসাকে দেখতে পান এখন?" 
রিয়া কোনো কথা বলে না। চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। 
ডাক্তার সাহেব বললো, " রিয়া, তোমার কি কোনো বাচ্চা আছে? বা ছিলো?"
রিয়া বলে, "হুম.. আমার এক মেয়ে ছিলো। ওর নাম নিশাত।"
"তুমি কি নিশাতকেও দেখতে পাও?"
রিয়া কোনো কথা বলে না। 
আসজাদ সাহেব বললেন, "রিয়া.. তুমি এখন যেতে পারো। পাশের রুম থেকে রবিনকে পাঠাও।"
রিয়া যাওয়ার সময় ডাক্তারকে বলে, "আপনার চেম্বারে একটা ফ্রীজ রাখবেন। সেখানে ঠান্ডা পানি রাখবেন। মাঝে মাঝে খাবেন। ভালো লাগবে।"
আসজাদ সাহেব কোনো কথা বলেন নি।
৩.
ডাক্তার আসজাদের সামনে বসে আছে রবিন। আসজাদ বলেন, 
"রবিন? আপনি ঠিক কিসে জব করেন কি একটু খোলাসা করে বলবেন?"
"জ্বি, অবশ্যই। আমি একজন কেমিস্ট। ক্যামিকেল নিয়ে কাজ করি। একটি রিসার্চ সেন্টারে কাজ করছি।"
"ওহ.. আচ্ছা! ভালোই! আপনার স্ত্রীর সমস্যাটা কবে থেকে?"
"এইতো.. প্রায় ৬ মাস?" 
"আচ্ছা.. আপনার বাচ্চার মৃত্যু কবে হয়?" 
রবিন অবাক হয়। বলে, 
"বাচ্চা? আমার তো কোনো বাচ্চা নেই।" 
ডাক্তার সাহেব চমকালেন। 
"মানে? আপনার কোনো বাচ্চা-ই নেই? শিউর আপনি?" 
"হাহা...  এটা কোন ধরনের প্রশ্ন? আমার বাচ্চা আছে কিনা? এটা আমি আবার শিউর কিনা? আমাদের কোনো বাচ্চা নেই।" 
ডাক্তার সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। 
"হুম..আচ্ছা! রবিন সাহেব.. আপনারা আসতে পারেন। আগামী সোমবার আপনাদের পরবর্তী সেশন। ওদিন এসে দেখা করবেন।" 
৪.
রবিন আর রিয়া গাড়ীতে বসে আছে। বাসায় ফিরছে তারা। দুজনেই নিশ্চুপ। কেউ কোনো কথা বলছে না। রিয়া হঠাৎ বলে, 
"রবিন, তোমার কি আমাকে পাগল মনে হয়?"
"না তো.. কেন?" 
"আমাকে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিলে কেন?"
"আরেহ.. এটা পাগলের ডাক্তার কে বললো? কাউন্সিলিং আমাদের কম বেশি সবার-ই দরকার।"
এমন সময় রবিনের ফোন বেজে উঠলো। রবিন বললো, 
"হ্যালো.. অনিকেত সাহেব? এসেছেন? বসুন অফিসে। আমি ১৫ মিনিটে আসছি।"
ফোনটা রেখে রবিন রিয়াকে বলে, "রিয়া, আমি একটু অফিসে যাব তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে। এসব বিষয় নিয়ে পরে কথা বলব।"
রিয়া বলে, "অনিকেত নামটা সুন্দর না? ইনি কে?"
রবিন বিরক্ত হয়, "এটা কি তোমার জানার বিষয়?" 
তাদের মধ্যে আর কোনো কথা হয় না। 
৫. 
রাত ৩.০০ বাজে। রবিন ঘুমোচ্ছে। আজ বাসায় এসে রবিন রিয়ার সাথে একটা কথাও বলে নি। তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো। রিয়া আর কথা বাড়ায় নি। রিয়া এখন বসে আছে ডাইনিং টেবিল এ। তার সামনের চেয়ারে বসে আছে নাফিসা। নাফিসার কোলে বসে আছে নিশাত। নাফিসার হাতে একটা গ্লাস। গ্লাসে ঠান্ডা পানি। নাফিসা ঠান্ডা পানি খাচ্ছে।
রিয়া নাফিসাকে বলে, "আচ্ছা? তুমি শুধু ঠান্ডা পানি খাও কেন? অন্য কিছুও তো খেতে পারো।"
নাফিসা রহস্যময় হাসি হেসে বলে, "আমাদের জাতীয় খাবার বরফ আর ঠান্ডা পানি।"
"তোমাদের জাতীয় খাবার মানে?" 
"হাহা.. মানে আমার আর নিশাতের!"
"বুঝলাম না কথাটা।"
"সব কিছু বোঝার দরকার কি?" 
হঠাৎ নিশাত বলে উঠলো, "আমিও ঠান্ডা পানি খাব।"
রিয়ার মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তার বাসায় প্রতিদিন রাতে এসব কি ঘটে? সে বলে, 
"নাফিসা, তোমার হাতের আংটিটা খুব সুন্দর। আংটিটা কোথা থেকে কিনেছিলে?" 
নাফিসা রহস্যময় হাসি হেসে বলে, "কোথা থেকে কিনেছিলাম মনে নেই। তবে এটা কেন ফ্রীজের নীচে পড়ে থাকে।"
রিয়া অবাক হয়। "মানে? ফ্রীজের নিচে মানে? কোথাকার ফ্রীজ?"
নাফিসা হো হো করে হেসে উঠে। এমন সময় হঠাৎ পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। আওয়াজটা আসছে ড্রইংরুমের ব্যালকনি থেকে।  রিয়া খুব অবাক হয়। একসময় সে দেখে, বারান্দা থেকে একটা ছায়ামূর্তি বের হয়ে আসছে। হেঁটে হেঁটে ডাইনিং এর কাছে আসে। লাইটের আলোয় দেয়া যায়, মানুষটি একজন পুরুষ। শ্যামলা গায়ের রং। লম্বা। চুল ছোট। লোকটা হুট করে একটা চেয়ারে বসে পড়লো। তারপর রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, "আমিও ঠান্ডা পানি খাবো।" রিয়া খুবই ভয় পায়। কোনো রকমে বলে, "আপনি কে?" 
লোকটি বলে, "আমার নাম অনিকেত।"
রিয়া কোথায় যেন নামটা শুনেছে। কিন্তু ঠিক মনে করতে পারলো না। তার আগেই সে বেঁহুশ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। 
৬.
আসজাদ সাহেবের চেম্বারে বসে আছে রিয়া। রবিন পাশের রুমে বসে আছে। আসজাদ সাহেবকে খানিকটা চিন্তিত মনে হচ্ছে। কিন্তু রিয়া নির্বিকার। আসজাদ সাহেবের হাতে একটা প্যাড আর কলম। তিনি বললেন, 
"গত রাতে কি হয়েছিলো, আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে বলুন। এভাবে মেন্টাল ট্রমা নিয়ে কতদিন থাকবেন? আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই। প্লিজ! বলুন।"
রিয়া বললো, "নাফিসা আর নিশাত এসেছিল বাসায়। ডাইনিং এ বসে ঠান্ডা পানি খাচ্ছিলো।"
আসজাদ সাহেব বললেন, " তারা কোন দিক দিয়ে বাসায় আসে? দরজা দিয়ে ঢুকে?"
"জানিনা আমি.." 
"ঠান্ডা পানি খায় কেন?" 
"আমি জানি না।"
"তারপর কি হলো?" 
"এক লোক এসে ভেতরে ঢুকলো। লোকটির নাম অনিকেত।"
"মানে? কোথা থেকে আসলো সে?"
"ব্যালকনি থেকে।"
"ওহ.. আচ্ছা। আর কোনো খুঁটিনাটি মনে আছে?"
"নাফিসার হাতে খুব সুন্দর এক আংটি আছে। সে বলছিলো এটা নাকি ফ্রীজের নিচে পড়ে থাকে।"
"ফ্রীজের নিচে?" 
"জ্বি।"
আসজাদ সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। এতোটা অবাক তিনি আগে হোন নি। তিনি তার ক্যারিয়ারে এমন কোনো রোগীর কেস পান নি। সবকিছুই জট পাকানো। কোনো কিছুরই কূল কিনারা হচ্ছে না। তিনি বললেন, "অনিকেত লোকটা সম্পর্কে কিছু বলুন?" 
রিয়া বলে, "কোথায় যেন তার নামটা শুনেছিলাম। মনে করতে পারছি না আমি।"
"কবে শুনেছিলেন?"
"গতকাল।"
"ওহ.. শেষ প্রশ্ন! আপনি নাফিসা বা নিশাতের মারা যাওয়ার পর তাদের লাশ দেখেছিলেন?" 
"না.. দেখি নি।"
"নিজের মেয়ে নিশাতেরটাও দেখেন নি?" 
"না.."
"অদ্ভুত"
আসজাদ সাহেব লিখে নিলেন সব। রিয়াকে বললেন, "আপনি এখন আসতে পারেন। রবিনকে বলে দিবেন তার সাথে আজকে আর কথা বলবো না। পরে কথা হবে। বিদায়।"
৭. 
আসজাদ সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন রবিনের সামনে। তারা দুজনেই এখন রবিনের অফিসে। অফিস না বলে বিশাল একটা ল্যাব বলা চলে এটিকে। 
আসজাদ সাহেব বললেন, "রবিন সাহেব। একটা কথা জানাতে আসছি। আমি আপনাদের ব্যাপারটি আর ম্যানেজ করতে পারব না।  আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করছি, আপনাদের আরো বড় কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট দরকার।" 
রবিন বললো, "ওহ.. আচ্ছা.."
আসজাদ সাহেব বললেন, "আমি খুব দুঃখিত। কিন্তু আমি আসলেই কূলকিনারা করতে পারছি না।" 
রবিন বললো, "আচ্ছা। বাদ দিন। বসুন। কি খাবেন? চা নাকি কফি?" 
"কফি হলেই হবে। তারপর?  রবিন সাহেব? আপনারা আপাতত কি নিয়ে কাজ করছেন ল্যাবে?"
"আমরা এমন একটা ক্যামিকেল আবিষ্কার করছি, যেটা সেবন করলে মানুষ অমরত্ব লাভ করবে।"
"অমরত্ব? মানে মানুষ আর মরবে না?" 
"ঠিক তাই.." 
"আজব.. কীভাবে?" 
রবিন রহস্যময় একটা হাসি হাসলো। বললো, "দেখুন ডাক্তার সাহেব, কাটা দিয়ে কিন্তু কাটা তোলা যায়। বিদ্ধ হওয়া কোনো কাটা তোলার জন্য তাজা কাটার প্রয়োজন হয়। তেমনি কিছু জীবন বাঁচানোর জন্য..."
"রবিন সাহেব? আপনি কি বলতে চান?" 
"তেমন কিছু না। আমরা কিছু ডেড বডি নিয়ে গবেষণা করে আবিষ্কার করার চেষ্টা করছি মৃত্যুর মেকানিজম! আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। আশা করি বুঝতে পারছেন।" 
আসজাদ সাহেব প্রায় সাথেসাথেই বললেন, "আপনার পেছনের বড় মেশিনটা কি ফ্রিজার?"
রবিন বললো, "হু.. এটা ফ্রীজ।"
আসজাদ সাহেব বললেন, "ফ্রীজারটার নিচে কি আছে একটু দেখতে পারি আমি?" 
রবিন অবাক হলো। 
"ফ্রিজারের নিচে দেখবেন মানে? আচ্ছা.. দেখুন।"
আসজাদ সাহেব ফ্রিজারের সামনে গেলেন। এবং নিচু হলেন। ফ্রীজারের নিচে মেঝেতে একটা ছোট স্বর্ণের আংটি ঝকঝক করছে। আসজাদ সাহেব উঠে এলেন। রবিনকে বললেন, "নাফিসা, অনিকেত, নিশাত এরা সবাই কি এই ফ্রীজারের ভেতর?"
রবিন হো হো করে হেসে উঠলো। বললো, "ডাক্তার সাহেব! আমি জানতাম আপনি একজন বুদ্ধিমান লোক। তবে এতোটা বুদ্ধি আপনার থাকবে কল্পনা করি নি।"
"আমি মোটেও বুদ্ধিমান না.. হয়তো আপনি কিছু জায়গায় বোকামি করেছেন।" 
রবিনের মুখ শক্ত হয়ে যায়। 
আসজাদ সাহেব বলেন, "নাফিসা আর অনিকেতের কথা মানা যায়.. কিন্তু নিশাত? নিজের মেয়েটাকে খুন করলেন কেন আপনি?" 
"নিশাত আমার মেয়ে না।"
"মানে? এটা রিয়ার মেয়ে না?"
"এটা রিয়ার আগের পক্ষের সন্তান।"
"মানে? রিয়ার আগে বিয়ে হয়েছিল? আমাকে জানান নি।"
"কারণ আপনি জানতে চান নি।"
"আমি কেন জানতে চাইবো? আপনাদের উচিত ছিলো সব আমাকে জানানো!" 
" আমি এই বিষয়ে আর কথা বলতে চাই না।"
"এদেরকে কীভাবে মেরেছিলেন?" 
"আমি জবাব দিতে বাধ্য নই।"
"আচ্ছা.. আমি উঠি আজ। অন্য কোনো দিন দেখা হবে।" 
রবিন কোনো কথা বলে না।
ডাক্তার সাহেব চলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ মাথায় ভোঁতা এক যন্ত্রনা অনুভব করলেন। তার মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। তিনি পেছনে তাকাতেই দেখলেন রবিন বুনো দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে একটি লোহার রড। আসজাদ সাহেবের মাথা থেকে প্রচুর রক্ত যাচ্ছে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ হয়ে আসে তার। 
৮. 
রাত ৩.০০ বাজে। রবিন রিয়ার পাশে ঘুমোচ্ছে। রিয়ার চোখে ঘুম নেই। সে এমনিই শুয়ে আছে৷ হঠাৎ ডাইনিং এ কারো চলার শব্দ পেয়ে ঘুম থেকে উঠে সে। চারপাশ অন্ধকার। রাস্তায় যথারীতি সোড়িয়াম বাতি জ্বলছে! রিয়া গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যায় ডাইনিং এর দিকে। লাইট দিতেই দেখে একজন ৪০ বছর বয়সী পুরুষ৷ লম্বা, ফর্সা। চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা। লোকটি আসজাদ সাহেব। তিনি রিয়াকে দেখতেই তার দিকে তাকিয়ে বললেন, "রিয়া, আপনাদের বাসার ফ্রীজটা খুঁজে পাচ্ছি না৷ আমাকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিবেন প্লিজ?" 
(সমাপ্ত)

No comments: