Saturday, June 25, 2022

আরেক ফাল্গুন উপন্যাসে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভুমিকা ।

 জহির রায়হানের 'আরেক ফাল্গুন' উপন্যাসের কাহিনী অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। কাহিনীর স্থিতিকাল মাত্র তিনদিন দুই রাত। প্রথম দিনের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে কাহিনির সূচনা। প্রথম দিন, রাত এবং দ্বিতীয় দিন ও রাত ধরে চলেছে একুশ পালনের বিরামহীন প্রস্তুতি। তৃতীয় দিন কাহিনির চূড়ান্তকাল। মিছিল এবং পুলিশের সংঘর্ষের মাধ্যমে অতিক্রান্ত হয়েছে এ চূড়ান্ত কালটি। অতঃপর দিনের শেষে কারা তোরণ প্রাঙ্গণে কাহিনির পরিসমাপ্তি। সেই জন্য কাহিনির ব্যাপ্তিকাল সীমিত। কিছু ঘটনা ও উদঘটনায় বিস্তৃত উপন্যাসের কলেবর।

সিপাহি বিদ্রোহের নির্মম স্মৃতিবিজড়িত ভিক্টোরিয়া পার্কের বর্ণনা দিয়ে ঔপন্যাসিক উপন্যাসের কাহিনির সূচনা করেন। 'সকালে কুয়াশায় ঢাকা পড়েছিল পুরো আকাশটা। আকাশের অনেক নিচু দিয়ে মন্থরগতিতে ভেসে চলেছিল একটুকরো মেঘ। উত্তর থেকে দক্ষিণ-রং তার অনেকটা জমাট কুয়াশার মতো দেখতে। ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে ঠিক সেই মেঘের মতো একটি ছেলেকে হেঁটে যেতে দেখা গেল নবাবপুরের দিকে। দক্ষিণ থেকে উত্তরে। পরনে তার সদ্য ধোয়ানো সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট, পা-জোড়া খালি। জুতো নেই।'

এই ছেলেটিই 'আরেক ফাল্গুন' উপন্যাসের নায়ক মুনিম। মুনিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা। সিপাহি বিদ্রোহের স্মৃতিময়তা এই উপন্যাসের সূচনাকে করেছে তাৎপর্যময় এবং বর্ণনায় প্রকৃতির পরিচর্যা কাহিনীকে করেছে সংকেতময়। মেঘের গতি উত্তর থেকে দক্ষিণে আর মুনিমের গতি দক্ষিণ থেকে উত্তরে। বর্ণনার এই সংকেতময় ইঙ্গিতটি শৈল্পিক। উপন্যাসের শেষাংশে বর্ণনায় এই ইঙ্গিত আরও সম্ভাবনাময় ও সুদূরপ্রসারী বলে মনে হয়েছে। যেমন- 'নাম ডেকে ডেকে তখন একজন একজন করে ছেলেমেয়েদের ঢোকানো হচ্ছিল জেলখানার ভেতরে। নাম ডাকতে ডাকতে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন ডেপুটি জেলার সাহেব। এক সময় বিরক্তির সঙ্গে বললেন, উহ অত ছেলেকে জায়গা দেবো কোথায়? জেলখানা তো এমনি ভর্তি হয়ে আছে। ওর কথা শুনে কবি রসুল চিৎকার করে উঠল, জেলখানা আরও বাড়ান সাহেব। এত ছোট জেলখানায় হবে না। আর একজন বলল, এতেই ঘাবড়ে গেলে নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো।'

সরকার ছাত্রছাত্রীদের শহিদ দিবস পালন করতে দেবে না। রাস্তায় সেস্নাগান দেওয়া নিষিদ্ধ। মিছিল, শোভাযাত্রা বেআইনি ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু ছাত্ররা বদ্ধপরিকর, তারা যে কোনো মূল্যে শহিদ দিবস পালন করবে। সে জন্য তারা পূর্ব থেকে বিভিন্ন কর্মসূিচ ঘোষণা করেছে। তাদের কর্মসূচির মধ্যে তিনদিন নগ্ন পায়ে চলা, সবাই রোজা রাখা, কালো ব্যাজ ধারণ করে ২১ ফেব্রম্নয়ারিতে কালো পতাকা উত্তোলন করা ইত্যাদি উলেস্নখযোগ্য। ছাত্রদের এ সব কর্মসূচি বাস্তবায়নে মুনিম-আসাদ দিন-রাত কাজ করে যায়। পোস্টার ও লিফলেট ছাপানো, কালো ব্যাজ বিতরণ, কালো পতাকা উত্তোলন, সেস্নাগান ও অন্যান্য সাংগঠনিক কর্মকান্ডে মুনিমের সক্রিয়তা বিরামহীন। আন্দোলনের সময় মুনিমকে নগ্ন পায়ে আসতে হয় দয়িতা ডলির জন্মদিনের উৎসবে। ব্যস্ততার কারণে ডলিকে সময় দিতে পারে না মুনিম। আন্দোলনের তেতৃত্ব দিতে গিয়ে মুনিমকে যোগ দিতে হয় বিভিন্ন ছাত্রসভায়। তাই ডলিকে একান্ন সান্নিধ্য দিতে পারে না সিনেমাতে। অভিমানী ডলি তাই রাগে ক্ষোভে তাকে প্রেরণ করে প্রত্যাখ্যানপত্র। মুনিম আহত হয়। কিন্তু রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ থেকে সে এক মুহূর্তের জন্য বিচু্যত হয় না। এটা তার রাজনৈতিক আদর্শনিষ্ঠা ও কর্তব্য। কিন্তু ডলির প্রতি অবজ্ঞা কিংবা আন্তরিকতাহীন তা কিন্তু নয়। মুনিম ডলিকে বিস্মৃত হয়নি। রাজনৈতিক কর্মব্যস্ততার আসরে ডলি তার কাছে হয়ে উঠেছে স্মৃতিলোকের মহারানী।



 


আন্দোলনে মুনিম একা নয়। সংগ্রামী উদ্দীপনায় এগিয়ে এসেছে সালমা, নীলা, রানু, বেনু, রাহাত, আসাদ, কবি রসুল, সাহানা প্রমুখ শত শত ছাত্রছাত্রী। রাজপথে তাদের আন্দোলন নিষিদ্ধ জেনেও তারা অবলম্বন করে ভিন্ন পথ। অবশেষে ২০ ফেব্রম্নয়ারি রাতে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শহিদ দিবসের উন্মাদনা ও আত্মদানের মহান ব্রত দেখা যায়। সারারাত কেউ ঘুমায় না।


মেডিকেল হোস্টেল, মুসলিম হল, চামেলি হাউস, ইডেন হোস্টেল, ফজলুল হক হল ইত্যাদি হলের ছাত্রছাত্রীরা অতন্দ্রপ্রহরীর মতো সারারাত জেগে রইল। কেউ কেউ জটলা বেঁধে কোরাস গান ধরল 'ভুলবো না, ভুলবো না, একুশে ফেব্রম্নয়ারি'। ফজলুল হক হলের সামনের মাঠে কাগজ দিয়ে ছাত্ররা স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তুলল। ১৯৫২ সালেও মেডিকেল হোস্টেলের ব্যারাকের সামনে তারা রাতারাতি শহিদ মিনার তৈরি করে রেখেছিল। কয়েকদিন পর পুলিশ এসে সে মিনার ভেঙে দিল। তারপর ছাত্ররা কঞ্চি দিয়ে সেই নির্দিষ্ট স্থানটি ঘেরাও করে রেখেছিল। এখানেও মেডিকেলের ছাত্ররা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। অবশেষে কালো পতাকা উত্তোলিত হলো। ছাত্রদের সেস্নাগান ও ব্যারিকেড ভেঙে পুলিশ লাঠিচার্জ করল; এরপর মেডিকেল ব্যারাক ঘেরাও করে ছাত্রদের বেধড়ক মারধর করল। পুলিশ ছাত্রছাত্রীসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। এরপর সকাল ১০টার দিকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রছাত্রীরা এসে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে জমায়েত হতে লাগল এবং সেখানে কালো পতাকা উত্তোলন হলো। এখানেও পুলিশ গুলি চালায়, অনেক ছাত্রছাত্রী আহত হয় আবার অনেককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। প্রিজন ভ্যানে উঠে ছাত্রছাত্রীরা সেস্নাগান দিতে থাকে- 'শহিদের খুন ভুলবো না, বরকতের খুন ভুলবো না'; 'শহিদ স্মৃতি অমর হোক'। এভাবে প্রায় আড়াইশ'র মতো ছাত্রছাত্রীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

উপন্যাসের তৃতীয় দিনে চূড়ান্ত ঘটনাংশে আগের তুলনায় মুনিমকে ততোটা সক্রিয় মনে হয়নি। এ অংশে মুনিম অপেক্ষা আসাদ অধিক সক্রিয়। মিছিলে পুলিশের সংঘর্ষে মুনিম আহত হয়। গ্রেপ্তার হয়ে অপেক্ষা করে কারাগারের প্রাঙ্গণে। অতঃপর ডলি আর সাহানার আকস্মিক আবির্ভাবে বেদনাবিহ্বল মুনিম হয়ে ওঠে আনন্দে উদ্বেল। ডলি একমুঠো ফুল নিবেদন করে মুনিমকে। ডলির বিচ্ছেদ বেদনার পরিবর্তে কারাবাসী মুনিম বরং আনন্দবোধ করে। 'মুনিম মৃদু গলায় বলল, হয়তো দীর্ঘদিন তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না ডলি। ডলি চোখ তুলে তাকালো ওর দিকে। স্বল্প অন্ধকারেও মুনিম দেখলো, ডলির চোখজোড়া পানিতে ছল ছল করছে। আনন্দে মনটা নেচেছিল বারবার। আর সে শুধু চেয়ে দেখছিল ডলিকে। ডলির এমন রূপ আর কোনোদিন চোখে পড়েনি মুনিমের।'


উপন্যাসের কাহিনী বিস্তারে আপসহীন ছাত্রনেতা হিসেবে মুনিম ও আসাদের চরিত্র উজ্জ্বল। মুনিম পিতৃহীন, দরিদ্র বিধবা মায়ের সন্তান। মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা ও আপত্তি, সংসারের টানাপড়েনে কিংবা প্রবল আন্দোলনের সময়ে প্রেমাষ্পদ ডলির প্রত্যাখ্যান কোনো কিছুই আন্দোলনের গতিধারা থেকে তাকে বিচু্যত করতে পারেনি। তাই মুনিম চরিত্রে রাজনৈতিক আদর্শনিষ্ঠা ও প্রণয়নিষ্ঠা উভয়ই সমান্তরাল গতিতে প্রবহমান। অন্যদিকে আসাদও একজন একনিষ্ঠ বিপস্নবী ছাত্রকর্মী। পিতার গালাগাল ও আর্থিক অসহযোগিতা তাকে আন্দোলনের মাঠ থেকে স্থানচু্যত করতে পারেনি। রাজনৈতিক ক্রিয়া-কর্মে সে নিজেকে সারাক্ষণ সক্রিয় রেখেছে। বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ থেকে শুরু করে কালো ব্যাজ ও কালো পতাকা বিতরণ ইত্যাদি কাজেও সে ছিল ক্লান্তিহীন। উপন্যাসের শেষের দিকে আসাদকে বেশ সক্রিয় মনে হয়। পুলিশের প্রবল বাঁধার মুখে ছেলেরা যখন ছত্রভঙ্গ তখন চিৎকার দিয়ে প্রতিরোধের জোর আহ্বান জানিয়েছে আসাদ ছাত্রদের। বায়ান্ন সালের মতোই সর্বাগ্রে যেন পুলিশের নির্যাতন সহ্য করে বন্দি হয়েছে। মামলার কোমল স্পর্শে আসাদের হৃদয় হয়েছে উদ্বেলিত। আন্দোলন চলাকালে সালমার বাসায় আশ্রয় নেয় আসাদ। শীতের গভীর রাতে জ্বলন্ত স্টোভের পাশে বসে আসাদ ও সালমা।


'আসাদ বলল, সত্যি ভীষণ শীত পড়ছে। হাতজোড়া বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে' দেখুন বলে, হাত দুটো ওর দিকে এগিয়ে দিল আসাদ। অন্ধকারে মৃদু হাসলো সালমা। হাত বাড়িয়ে ওর হাতের তাপ অনুভব করতে গেলে হাতজোড়া আলতো ধরে রাখলো আসাদ।'

ডলি বিত্তশালী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। ছাত্রনেতা মুনিমের প্রেমিকা। ডলি যতটা ব্যক্তি মুনিমের ভক্ত, তার আদর্শের প্রতি ততোটা বিরক্ত। ডলির জন্মদিনের উৎসবে শহিদ স্মৃতির সম্মানে নগ্নপদ যাত্রী মুনিমের উপস্থিতিতে ডলি বিব্রতবোধ করে। এই বিব্রতবোধের কারণ মুনিম নিজে না, তার নগ্নপদযুগল। ডলির উচ্চারণ, 'এমন করে আমাকে অপমান করতে চাও কেন শুনি।' এরপর ডলি মুনিমকে তার বাবার স্যান্ডেল পরতে পরামর্শ দেয়। মুনিম কারও সামনে বিব্রত হোক, উপহাসের পাত্র হোক ডলি তা চায় না। প্রবল ব্যস্ততার কারণে ডলিকে সময় দিতে পারে না মুনিম। তাই ডলি হয়ে ওঠে বিক্ষুব্ধ। এই অভিমানী ডলি মুনিমের উপহারসামগ্রী ফেরত দিয়ে প্রেরণ করে রিফিউজ লেটার। এত অল্প সময়ের মধ্যে বা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রিফিউজ করা সত্যিই ভাবিয়ে তোলে পাঠককে। এরপর ডলি গ্রহণ করে বজলকে। বজলের সঙ্গে সর্বত্র তার অবাধ বিচরণ। মুনিম থেকে বজলকে ডলি বেশি ভালোবাসে তা কিন্তু নয়; এটা ডলির অভিমানী হৃদয়ের বিশেষ খেয়াল। এক সময় বজলের কপটতা ও মিথ্যাচারিতা ডলি বুঝতে পারে। অবশেষে ডলি ফিরে আসে মুনিমের কাছে। কারাযাত্রী মুনিমকে একগুচ্ছ পুষ্পার্ঘ দিয়ে বরণ করে ডলি। সালমা মেডিকেলের ছাত্রী, কারারুদ্ধ বিপস্নবী, রওশনের স্ত্রী। সে আন্দোলনে কঠোর, হৃদয়বীর্য কোমল। রওশন সালমার বড় ভাইয়ের বন্ধু। সালমা তাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলনে স্বামী হয়েছে কারারুদ্ধ। কারারুদ্ধ হয়েছে তার ছোট বোন ও ভাই। রাজশাহী জেলে গুলি করলে স্বামী রওশন হারায় দুটি হাত। প্রণয়দগ্ধ, বেদনাদগ্ধ সালমা তাই হয়ে ওঠে ভাষা আন্দোলনের একজন নির্ভীক আন্দোলন কর্মী। স্বামী রওশনের খন্ডিত হাত কখনো সেস্নাগানে উত্তেজিত হবে না, নিবিড় আলিঙ্গনে সালমাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করবে না- একথা ভাবতে গেলেই সালমার হৃদয় মুচড়ে ওঠে। স্বামীর কারামুক্তির সম্ভাবনাও অনিশ্চিত। অভিভাবক হিসেবে সালমার চাচা বিবাহ বিচ্ছেদের পরামর্শ দিলে সালমা তাতে রাজি হয় না।

অন্যদিকে, রওশনের চিঠিতেও অনুকূল সাড়া আসে না। এই দো-টানা পরিস্থিতিতে সালমা নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকে এবং হয়ে ওঠে স্বামী আদর্শচারী। তার চরিত্রের এই দৃঢ় চেতনাই তার ভালোবাসার খাঁটিত্ব প্রমাণিত হয়। আসাদকে সালমার ভালো লাগার একটা কারণ হচ্ছে কথা বলতে গেলে হঠাৎ রওশনের মতো মনে হয়, বিশেষ করে ঠোঁট আর চিবুকের অংশটুকু। তবে সালমার এ ভালোলাগার মধ্যে কোনো অনুরাগ নেই, রয়েছে সালমার বিরহদগ্ধ সংবেদনশীল হৃদয়ের সাময়িক বিভ্রম মাত্র।

বজলের প্রিয় বন্ধু মাহমুদ। গোয়েন্দাকর্মী মাহমুদ কবিতা লেখে। মানসিক দিক দিয়ে উভয় বন্ধুর আদর্শ অভিন্ন। তারা দুজনই সাহিত্যিক ও নারী লিপ্সু। তবে রমণী রমণে মাহমুদের পারদর্শিতা সমধিক। সে ভালোবাসার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছে ঢালী ক্লার্কের মেয়ে সালেহাকে আবার বিয়ে করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে সাহানাকে। এই প্রতিশ্রম্নতি আর অঙ্গীকার করে দুটি মেয়েকেই করেছে সে কলঙ্কিত ও কলুষিত। যার ফলে সালেহা করেছে আত্মহনন আর সাহানা হয়েছে প্রত্যাখ্যাত। 'আরেক ফাল্গুন' উপন্যাসে ছাত্রদের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামী চেতনার পাশাপাশি সুবিধাভোগী রাজনৈতিক নেতাদের মতো মধ্যবিত্তসুলভ মানসিকাপুষ্ট ছাত্রছাত্রী স্বার্থান্ধ কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের কথা জহির রায়হান অকপটে বর্ণনা করেছেন সুনিপুণভাবে। প্রসঙ্গক্রমে বজলের একটি উক্তি উলেস্নখ করা যায়।



'আমরা হলাম সাহিত্যিক। সমাজের আর দশটা লোক, মিছিল আর শোভাযাত্রা বের করে পুলিশের লাঠি খেয়ে প্রাণ দিলে কিছু এসে যায় না। কিন্তু আমাদের মৃতু্য মানে দেশের এক একটি প্রতিভার মৃতু্য।' বজলের এই স্বার্থপর উক্তি থেকেই বোঝা যায়, সমাজ বা রাষ্ট্রে তার অবস্থান কোথায়? জহির রায়হানের জীবন দৃষ্টি রোমান্টিক। 'আরেক ফাল্গুন' উপন্যাসে এই রোমান্টিক দৃষ্টির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন তিনি সফলভাবে। রাজনৈতিক পটভূমিতে এটি রচিত হলেও প্রণয় উপেক্ষিত নয়। ডলি মুনিমের প্রেমানুভূতি আর সালমা ও রওশনের অকৃত্রিম হৃদয়ানুভূতিই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। উপন্যাসের মূল কাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য উপ-কাহিনী। পস্নট সংগঠনে লেখকের নৈপুণ্য সর্বত্র রক্ষিত হয়নি। চরিত্র অনুসারে ভাষা ব্যবহারে লেখক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সর্বোপরি, বর্ণনার আবেগের সঙ্গে ঘটনার প্রবহমানতা একাত্ম করে জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনের তথা একুশের প্রথম উপন্যাস রচনা করে স্মরণীয় হয়ে আছেন।



বাঙালি জাতীয়তাবাদী

 ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষও ঘটে ঔপনিবেশিক আমলে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে। এক ভাষা ও সংস্কৃতির একদল মানুষ দীর্ঘ সংগ্রামে একত্রে আনতে সক্ষম হয় বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে। সেখান থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের শুরু। কিন্তু ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা কিংবা তারও আগে ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা দুই ধরনের জাতীয়তাবাদের ধারক- বাহক রূপে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে; যদিও কংগ্রেসের মধ্যে কিছুটা উদারতা ছিল অন্যান্য সম্প্রদায়ের ব্যাপারে। এক সময় এদের অবস্থান দুই বিপরীত মেরুতে চলে যায়। মুসলিম জাতীয়তাবাদের নেতা মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ’র দ্বিজাতি তত্ত্ব ও লাহোর প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে মুসলিম জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়। ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালের মধ্যরাতে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষ  ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।  এর পূর্ব অংশ বাংলা একটি প্রদেশ হিসেবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং পূর্ব  পাকিস্তান নামে পরিচিত হয়।  মূল পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু শুরু হতেই পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা পশ্চিম পাকিস্তানের এলিটদের হাতে ন্যস্ত ছিল। ফলস্বরূপ, পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থার উপর পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ছড়ি ঘুরাচ্ছিল। সমস্ত অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণ কথা বলতে গিয়ে সবাই এক প্লাটফর্মের যাত্রী হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় বাঙালি স্বাজাত্যবোধ ও তার পরিণাম গণ আন্দোলন ও মুক্তির আকুতি। 

বাঙালির মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রাম হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির অধিকার সচেতনতার  প্রথম ধাপ; পর্যায়ক্রমে যা বিকশিত হয়ে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন, ছয় দফা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিরোধী সংগ্রাম, গণ অভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের উন্মেষ ঘটায়। 

বাংলা ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে জাতীয় এ ঐক্যের নামই বাঙালি জাতীয়তাবাদ।