Wednesday, January 30, 2019

শাবলু শাহাবউদ্দিন একটি ছোট গল্প ।

কাল যে আমার এস এস সি পরীক্ষা 

শাবলু শাহাবউদ্দিন


আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন যেন অমাবস্যার রাত। রেনুর মায়ের মাথার আঁকাবাঁকা খোলা চুলের মত দুলছে, হালকা বাতাসে নারকেলের সুশ্রী লম্বা লম্বা পাতাগুলো । ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজে কলা পাতার উপরে প্রতিফলিত হচ্ছে আলোর প্রাকৃতিক রশ্মি । দূরের পথটি ঝাপসা; কে যেন হেঁটে যাচ্ছে ছাতা মাথায় দিয়ে, তাই দেখছি, জানালার এক পাল্লার খোলা অংশিক জায়গা দিয়ে । জানালাটা বিছানার ধারে হওয়ায়, খুব খুশি হয়েছিল শাবলু ভাই। দিনের আলোতে বিছানায় শুয়ে বুকের তলে বালিশ দিয়ে কাপড় সেলাই মেশিনের মতো শব্দ করে পড়ে ভাইয়া ।পড়ে খুব মনোযোগ  সহকারে, পড়তে বসলে বাইরের পৃথিবীতে কি হচ্ছে তা আর তার কান পর্যন্ত আসতো না । এই স্বভাবের জন্য দাদা তাকে কত না গালাগালি দেয় ।
দিনটা ছিল রবিবার । ভাইয়ের যে , আজ এসএসসি  এর রেজাল্ট দিবে তা আমার মনেই ছিল না । মনে না থাকারও একটা কারণ আছে ;আজ তিন সপ্তাহ হল শুনছি, আজ না কাল , কাল না পরশু, পরশু না তরশু রেজাল্ট দিবে । এমন হলে কি কারি বা মনে থাকে ।
কালামের মা নাসিদা চাচির ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠ ভেসে আচ্ছিল দরজার এক পাল্লার  হালকা একটু ফাঁক দিয়ে ," ঐ তোরা শুনছিসলো ? আজ শাবলুর রেজাউল  হয়েছে ।"
শব্দগুলো শুনে মন ভরে যাচ্ছিল । ভাবছিলাম অনেক দিন হল মিষ্টি খাই নাই । আজ ভাইয়া পাস করে অনেক  মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরবে । আমরা সবাই মিষ্টি খাবো ।পাড়ায়পাড়ায় মিষ্টি বিলাইবো। কি মজা ! কি মজা ! বলে মনটা নেচে উঠল ।
কিন্তু কিছু খনের মধ্যে কণ্ঠ টা আগুনের ধোঁয়ার মতো অন্য দিকে মোড় নিল। যে কথা কিছু খন আগে শীতের সকালের আগুন পোহানোর মতো মজা দিচ্ছিল। সেই কথা যেন ভেজা খড়িতে আগুন দিয়ে ধোঁয়া পোহানোর মতো মনে হতে লাগল। আগুনের ধোঁয়া যেমন চোখকে আঘাত করে ঠিক নাসিদা চাচির কথা যেন আমার মনকে আঘাত করলো। তাঁর কথা আমার আর শুনতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তবুও রাতের ঝিঝিপোকার ডাকের লেহান আমার কানে এসে লাগতে লাগলো:-
"কইলো তোরা? আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না?"
মা উত্তর দিলো,"কি হয়েছে ভাবি?"
:- তোদের শাবলুর রেজাউল হয়েছে ।
---- কে বললো আপনাকে?
:- কালাম কেবলই বাজার থেহান শুনে এলো।
----ওহ্, কি রেজাল্ট শুনলো কালাম, ভাবি?
:- শাবলু নাকি পাস করে নাই । ছাওয়ালটা কত পড়তো ,তবুও পাস করতে পারলনা।আল্লার কি একটুখানি দয়ামায়া না _____________ইত্যাদি ইত্যাদি ।
মায়ের কণ্ঠ আর কোন প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছি না । হইত মা মনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছে কিংবা আঁচল চাঁপা দিয়ে তার চোখের নোনা জলের মজিব বাঁধ দিচ্ছে নতুবা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছ ।
এই ঘর থেকে আমি আর কিছুই শুনতে পাচ্ছি না । চাচি যে গেট খুলে চলে গেল তার একটা শব্দ এসে কানে লাগল।
মনের মাধুরী মিশাইয়া বুক ভরে ভাইয়ার গলাধরে কাঁদতে ইচ্ছে হল । তা আর  পারলাম না ।ভাইয়া বাড়িতে নাই। সেই সকালে দু'মঠো চিরা খেয়ে বেড়িয়েছে ।
বিছানায় উপর উপুড় হয়ে খুব কান্না কাদলাম ।বাইরের বৃষ্টি আজ আমার চোখের ধারার কাছে হার মেনে গেল ।কোন এক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলাম । সাড়াটা রাত ঘুম কিংবা অজ্ঞান হয়ে কেটে গেল।বাড়ির হয় তো সবার একই অবস্থা হয়ে ছিল । খোঁজ হীন সবাই ।
সকালে মায়ের কণ্ঠ শুনে ঘুম ভাঙল। মা বললো ,"উঠে, হাত মুখ ধোয়ে খেতে আয়"।
সকালের আকাশ টা পরিষ্কার; বেলা উঠে তার সোনালি কিরণ দ্বারা গাছের উপর পড়া বৃষ্টির পানি ফোঁটা গুলো চুষতে শুরু করে দিয়েছে , হাতি যেমন শুর দিয়ে পানি তোলে।
সূর্যের দিকে চেয়ে তাকাতে পারছিলাম না । হাত মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসে দেখলাম আজ আর কেউ মজা করল না আমার সাথে । খাওয়া শেষে বাবা ,ছোট চাচাকে ডেকে বললো, "একটু বাজারে যা "।
চাচা উত্তরে বললো, "কেন?"
---- "শাবলুর একটি খবর যেনে আয়, কোথায় কেমবা গেলো, কাল রাতে বাড়ি ফেরেনি । বাজারে গিয়ে একটা খোঁজ নে।"
কথা গুলো শুনে চাচার মাথায়যেন আগুন ধরে গেলো , সেই আগুনে কালো ধোঁয়া মুখ দিয়ে বের হতে লাগল:-
"শাবলুরে খোঁজ নিব আমি? ঐ হারামজাদারে খোঁজ নিব? কখনওই না ।ওর জন্য কি করি নাই আমি ।সারারাত জেগে নকল লেখছি । পরীক্ষা হলে কত কষ্ট করে জানালার ফাঁক দিয়ে ওর কাছে নকল পৌঁছায়ে দিছি। তাঁর জন্য পুলিশের দাঁবড়ানিও খেয়েছি । তার ফল এল আজ ফেল _______________"
উপায় না পেয়ে বাবা নিজেই বাজারে গেলেন। দিন গেল ,রাত এল । আবার দিন গেল, রাত এল । আবার দিন এল ,সে দিন বুধবার ।বেলা তিনটা  বাজে। মায়ের কলে বসে বিস্কুট খাচ্ছি । হঠাৎ মাঠ থেকে এসে রহমান চাচা মাকে জিজ্ঞাসা করলো," বেলি তোমার ছাওয়ালটার কি কোন খোঁজ মিললো?"
মা উত্তরে বললো," না মিয়া ভাই, কোন খোঁজ মিলছে না । কত জনকে চিঠি দিছি, কোন উত্তর আসে নাই। ফোন করে অনেকের কাছে খবর পাঠাইছি । দেখি কি হয় ।"
মায়ের আপসোস দেখে রহমান চাচা মাকে বললো, "আল্লাহ্ জানে ছাওয়ালটা কোথায় গেছে, তবে ভয়ের কিছু নাই মায়ের বুকের দুধের জোর থাকলে অবশ্যই ফিরে আসবে"।
তারপরে চাচা আবার জিজ্ঞাসা করল," বেলি, তোমরা কি শুনছ, বিলের মাঠে মেশিন ঘরে একটা লাশ পরে আছে"।
উত্তরে মা বলল," না তো ভাই, কার লাশ?"
:- লাশ কার চেনা যাচ্ছে না। শিয়ালে  মুখ খানা খেয়ে নষ্ট করে ফেলছে। গায়ে একটা রক্ত মাখা চেক চেক শার্ট আছে। ঠিক শাবলুর জামার মত ।
কথা শেষ করে চাচা চলে গেলো। মা ছোট চাচাকে মাঠে পাঠিয়ে দিল ; লাশ টা কার জানার জন্য । কাকা যাইতে চাইলো না ।তবুও মায়ের চাপাচাপিতে না গিয়ে পারল না।
বেলা তখন পরে আসচ্ছে, আছরের নামাজ শেষ করে মুছুল্লিরা মসজিদের বাইরে যাচ্ছে । এমন সময় মাঠের দিকে চোখ পরতেই ; দেখি অনেক গুলো মানুষ দুঃখের শোক যাত্রা নিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে দেয়ে আসছে পদ্মার স্রোতে লেহান । সবার সামনে ছোট চাচা-- তার কাদে সেই অপরিচিত লাশ ; মুখ তাঁর শিয়ালে খেয়ে গেছে । ডান হাঁটুর মাংস নেই, পেটের কাছে ছিদ্র করে নাড়িভুঁড়ি টেনে বাহির করেছে নিষ্ঠুর প্রাণীগুরো।
লাশ টা মাঝ উঠানে নামাতেই, ছোট চাচা জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। বুঝতে আর দেড়ি হল না, লাশটা কার ।আমার তীক্ষ্ন চোখ যুগল চলে গেলো লাশের বা হাতের দিকে । বা হাতের বুড়ো আঙুলটি কাটা । এতো আর কারো লাশ না । শাবলু ভাইয়ের লাশ। মা নিজেও লাশ চিনতে ভুল করলো না ।ছোট চাচা তখনও বেহুঁশ ।সেও লাশ চিন্তে ভুল করে নাই।
হঠাৎ কে যেন পিছুন থেকে ডাক দিল ; কিরে বাড়ি যাবি না ? একা একা নদীর ধারে বসে কি ভাবিস? কাল না তোর এসএসসি পরীক্ষা । আর আজ তুই নদীর ধারে ধ্যানে বইছিস ।চিন্তা করিস না । আবুল ভাই তোরে গণিত প্রশ্ন রাতে কিনে এনে দিবে । দেখিস নিশ্চিত তুই এ+ পাবি। আর চিন্তার কোন কাজ নাই ।রাত হয়ে এলো ।বাড়ি আয়।
কথা গুলো এক নিঃশ্বাসে শেষ করে খালাত ভাই আবির বাড়ির দিকে রওনা দিলো।
হয় তো আজ আর কারো শাবলু ভাইয়ের কথা মনে নেই , এই একই কথা আবার ভাবতে লাগলাম । সবাই আবার মেতে উঠেছে আমার এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে । এখন উঠি ,রাত হয়ে এল ।  কাল যে আমার এসএসসি পরীক্ষা ।




লেখক পরিচিতি:

শাবলু শাহাবউদ্দিন
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়



আপনার লেখা পাঠাতে gmail করুন
sssompadasgupta@gmail.com

2 comments:

শুফম সাহিত্য পরিবার said...

nice

Unknown said...

* জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় লেখা পাঠান *
মাসিক শাপলা কুড়ি পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় জন্য লেখা পাঠান । লে খা পাঠান আগামী ১৫-০৫-১৯ইং মধ্যে।লেখা পাঠান প্রবন্ধ, কবিতা, ছড়া, ছোট গল্প, অনু গল্প, সাহিত্য সভার, বই ও পত্রিকা প্রকাশনার খবর,ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে খবর ইত্যাদি, পাঠাতে পারেন কোন বিষয়ের উপর ফিচার, লোক সাহিত্য । প্রকাশিত লেখার উপর লেখকে সম্মানী প্রদান করা হবে । লেখকে অবশ্যই পত্রিকা ক্রয় করা মনমানসিকতা থাক তে হবে । সকল বিষয় উন্মুক্ত, কবিতা ২৫ লাইন, অনু গ ল্প – ২৫০-৩৫০ শব্দ , প্রবন্ধ ও ছোট গল্প -৫০০ থেকে ১০০০ শ ব্দের মধ্যে, লেখার সঙ্গে লেখকের সং ক্ষিপ্ত পরিচিতি, পুরো ডাক ঠিকানা, ই- মেল আই-ডি পাঠাতে হবে । আরো বিস্তারিত জানার জন্য ফোন করুন-+917718298921
সম্পাদক
মাসিক শাপলা কুঁড়ি
ই- মেল-cbnripen921@ gmail.com
বিঃদ্রঃ যে কোনও বাংলা সাহিত্য এই পত্রিকায় প্রকাশ করা হয় #